বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ সম্পর্কে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য জানার জন্য খুবই আগ্রহী, বুঝে উঠতে পারছেন না এ বিষয়ে কোথায় সঠিক তথ্য পাবেন, অনেক লেখকের বই এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করেও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না? তাহলে এইবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ, অধাতব খনিজ সম্পদ, ধাতব খনিজ সম্পদ, চুনাপাথর, কাচবালি, শ্বেতমৃত্তিকা, কঠিন শিলা, নুড়ি পাথর, সৈকত বালি, গন্ধক, নির্মাণ বালি, তামা, লৌহ আকরিক সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। চলুন এইবার বিস্তারিত দেখে নিই।
ভূমিকা
কোন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের মাথাপিছু আয়ের সিংহভাগ শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে অর্জিত হয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল ঘন বসতিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র। আমাদেরও কিছু নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদকে দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়, যেমন ১। নবায়ন যোগ্য সম্পদ- মাছ, পানি, বনভূমি প্রভৃতি, ২। অনবায়নযোগ্য সম্পদ- প্রাকৃতিক সম্পদ, তেল, গ্যাস, কয়লা, বালি প্রভৃতি।
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ (Minerals Resource of Bangladesh)
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে ততটা সমৃদ্ধ নয়। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খনিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, আর্থিক সংকট, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ করতে পারেনি। দেশের উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ হলো- প্রাকৃতিক গ্যাস। দেশের অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে পহেলা চুনাপাথর কয়লা, চুনাপাথর, শ্বেতমৃত্তিকা, কাচবালি, কঠিন শিলা প্রভৃতি। নিম্নে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ গুলো বিবরণ দেওয়া হল। চলুন বিস্তারিত দেখে নিন-
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) অধাতব খনিজ সম্পদ ও
(খ)ধাতব খনিজ সম্পদ
(ক) অধাতব খনিজ সম্পদ
বাংলাদেশের অধাতব খনিজ সম্পদ গুলোর সম্পর্কে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য বিবরণ উল্লেখ করা হলো-
১। চুনাপাথর (Limestone)
১৯৬০ সালের প্রথম দিকে সুনামগঞ্জ জেলার টাকেরহাটে প্রথমে চুনাপাথরের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। এখানকার চুনাপাথর সিলেটের সিমেন্ট কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে একই জেলার বাগলিবাজার ও লালখানে চুনাপাথর আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬০ সালে ভূ-তাত্বিক জরিপ বিভাগ জয়পুরহাটে আরও একটি চুনাপাথরের খনি আবিষ্কার করে। জয়পুরহাট চুনাপাথরের উপর ভিত্তি করে এখানে একটি সিমেন্ট কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৯৯০ সালে নওগাঁ জেলার শাজাহানপুর ও পরানগরে চুনাপাথরের খনি আবিষ্কার করে। এছাড়া সীতাকুণ্ড ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে চুনাপাথরের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে খোলসযুক্ত চুনাপাথর রয়েছে। জিনজিরার বেশিরভাগ ভূমিতে বালি ও মাটির নিচে এ চুনাপাথর রয়েছে। ছেড়াদেয়ার ও দক্ষিণপাড়ার বেলাভূমিতে বালির নিচেও এই প্রকৃতির চুনাপাথর পাওয়া যায়। এখানকার চুনাপাথর বিভিন্ন প্রকার শামুক, ঝিনুক, কড়িসহ সামুদ্রিক জীবের খোলস জমে সৃষ্টি হয়েছে।
২। কাঁচবালি (Glass sand)
এই খনিজ সম্পদটি সাধারণত কাঁচ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় কাঁচবালির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই এলাকাটির অবস্থান ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। এছাড়া শেরপুর জেলার বালিজুরিতে, হবিগঞ্জ জেলার শাহাজী বাজারে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার ও মধ্যপাড়ায় কাঁচবালি সঞ্চিত আছে। যা ভূপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত।
৩। শ্বেত মৃত্তিকা (White Clay)
বাংলাদেশের নেত্রকোনা, শেরপুর,চট্টগ্রাম, দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় শ্বেতমৃত্তিকা পাওয়া যায়। সাধারণত এই মৃত্তিকা সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের ব্যাপকভাবে সিরামিক শিল্পে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই মৃত্তিকা দ্বারা তৈরি করা হয়।
পাকিস্তান ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ সর্বপ্রথম ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার ভেডিকুরা গ্রামে শ্বেতমৃত্তিকা আবিষ্কার করেন। ১৯৬৫ সালে নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় ভূগর্ভস্থ শ্বেতমৃত্তিকা আবিষ্কার করা হয়। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইস উপজেলায় শ্বেতমৃত্তিকা আবিষ্কৃত হয়। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় শ্বেতমৃত্তিকা ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার ভূরঙ্গা এলাকায় শ্বেতমৃত্তিকা আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯৪ সালে দিনাজপুরের দীঘাপড়ায় কয়লা অনুসন্ধানের সময় শ্বেতমৃত্তিকা আবিষ্কৃত হয়।
৪। কঠিন শিলা (Hard Rock)
কঠিন শিলা গৃহনির্মাণ, রাস্তাঘাট, রেললাইন, সেতু নির্মাণ, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি প্রকৃতি কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে নির্মাণ সামগ্রির সংকট রয়েছে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৯৬৬ সালে রংপুর জেলার রানীপুকুরে এবং দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলার সন্ধান পায়। কঠিন শিলার অবস্থান রানীপুকুরে ১৮২ মিটার এবং মধ্যপাড়ায় ১৩২ থেকে ১৬০ মিটার মাটির নিচে রয়েছে। এখানকার কঠিন শিলা প্রিক্যামব্রিয়ান যুগে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
৫। নুড়ি পাথর (Gravel)
হিমালয় পর্বতের পাদদেশে নুড়িপাথর সঞ্চিত আছে। এই নুড়ি পাথর বর্ষাকালে নদীর উজান প্রবাহে বা পাহাড়ি ঢল পানি দ্বারা বাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় চলে আসে। নুড়ি পাথরের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলো হল-সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জ ও পিয়ানগঞ্জ, পঞ্চগড় জেলার পঞ্চগড় ও তেতুলিয়া এবং লালমনিরহাট জেলর পাটগ্রাম। সীমান্ত এলাকায় প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘনমিটার নুড়ি পাথর সঞ্চিত আছে। এই নুড়িপাথর বিভিন্ন নির্মাণ কার্যে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এই পাথর ব্রিজ, কালভার্ট, ভবন, পাকারাস্তা, রেলপথ প্রভৃতি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়।
৬। সৈকত বালি (Beach sand)
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্র সৈকতে এই বালি রয়েছে। এই বালিকে আবার তেজস্ক্রিয় বালি ও বলা হয়ে থাকে। এখানে সঞ্চিত তেজস্ক্রিয়বালির মধ্যে জিরকণ, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, গারনেট, ম্যাগনেটাইট, খাইনাইট, রুটাইল সঞ্চিত আছে বলে ধারণা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ান একটি কোম্পানিকে এখানকার খনিজ সম্পদ সমীক্ষা ও আহরণের সম্ভাব্যতা নিরূপনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
৭। গন্ধক (Sulphur)
বাংলাদেশে এখনো গন্ধকের উৎপাদন তেমন বেশি নয়। দেশে কেবলমাত্র কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপে গন্ধক আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন রাসায়নিক শিল্পে, বিশেষ করে সালফিউরিক অ্যাসিড, কীটনাশক, বারুদ প্রভৃতি তৈরি এই খনিজ ব্যবহার হয়ে থাকে।
৮। নির্মাণ বালি (Construction sand)
বাংলাদেশের বিভিন্ন নদনদীর তলদেশে বা তীরে পর্যাপ্ত নির্মাণ বালি পাওয়া যায়। এই বালি স্ফটিকমনি দ্বারা গঠিত। তবে সকল স্থানের বালির দানা এই ধরনের নয়। কোন কোন স্থানের বালির দানা খুব মোটা আবার অনেক স্থানের দানা খুব ছোট। যে নির্মাণ বালির দানা মোটা ও স্ফটিকমনির পরিমাণ বেশি থাকে সেই বালি উন্নত। দেশের রাস্তা, ব্রিজ, গৃহ, কালভার্ট প্রভৃতি নির্মাণে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(খ) ধাতব খনিজ সম্পদ (Metallic minerals)
বাংলাদেশের ধাতব খনিজ সম্পদ গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১। তামা (Copper)
দিনাজপুরের মধ্যপাড়া ও রংপুরের পীরগঞ্জের ভূগর্ভস্থ আগ্নেয় শিলার সাথে তামা মিশ্রিত অবস্থায় আছে বলে জানা গেছে। এই তামা উত্তোলনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। তবে এই বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান কার্য এখনও চলছে।
২। লৌহ আকরিক (Iron ore)
দিনাজপুরের মধ্যপাড়া অঞ্চলে আগ্নেয় শিলার স্তরে লৌহ আকরিক সঞ্চিত আছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগ্নেয় শিলার ফাটল লৌহ আকরিক সহ অন্যান্য খনিজ উপাদান সঞ্চিত রয়েছে। তবে এই খনিজ সম্পদ এলাকার বিস্তৃতি এখনো নির্ধারিত হয়নি।
সাধারণত খনিজ সম্পদ আহরণের ফলে খনি এলাকার পরিবেশ নানাভাবে দূষিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ বেশি। এছাড়া কৃষি জমি নষ্ট, ভূমির নিম্নগমন, ভূমির কম্পন প্রভৃতি সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। কোন কোন সময় খনির ভিতরের পানি পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই পানিতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ থাকে যা কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস করে।
উপসংহার
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ গুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি আপনি, বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ বিবরণ সম্পর্কে সঠিক এবং পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। এই বিষয়ে যদি আপনার কোন মতামত থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন, এই ওয়েবসাইটের এডমিন প্রতিটা প্রশ্নের জবাব প্রদান করে থাকে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url