বাংলাদেশের কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহ বিস্তারিত আলোচনা
প্রিয় পাঠক, আপনি কি বাংলাদেশের কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহ বিস্তারিত আলোচনা পেতে খুবই আগ্রহী, এ বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক এবং ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করেও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাচ্ছেন না? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহ এই প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য। প্রতিবেদনটি মনোযোগের সহিত পড়তে থাকুন বিস্তারিত তথ্য পাবেন ইনশাল্লাহ।
ভূমিকা
গ্রাম প্রধান ও কৃষি প্রধান এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি এ দেশের জাতীয় ও রাজস্ব আয়ের উৎস, জনগণের খাদ্যের যোগান দেয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সহায়ক, বস্ত্র ও বাসস্থানের উপকরণ যোগায়, জ্বালানি সরবরাহ করে, শিল্পের কাঁচামাল যোগান দিয়ে শিল্প উন্নয়নের সহায়তা করে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ অনেক গুরুত্ব বহন করে থাকে। মোট কথা, কৃষি এদেশের মানুষের প্রধান পেশা।
বাংলাদেশের কৃষির বৈশিষ্ট্য
কৃষি বাংলাদেশের জাতীয় ও রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। জনগণের খাদ্যের যোগান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিরাট অবদান রাখে কৃষি। বাংলাদেশের কৃষির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলো নিম্নে উল্লেখ করা-
১। সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ
বাংলাদেশের সনাতন বা প্রাচীন পদ্ধতির চাষাবাদ এদেশের কৃষির একটি প্রধান উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। একটি কাঠের লাঙ্গল ও একটি বাঁশের জোয়াল এবং একজোড়া দুর্বল বলদ বা গরুই হচ্ছে এদেশের কৃষকদের কৃষি কাজের প্রধান হাতিয়ার। আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির সাথে তারা খুব একটা পরিচিত নয়। ফলের চাহিদার সাথে উৎপাদন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
২। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি
বাংলাদেশের কৃষির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কৃষিকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনৈতিক গড়ে উঠেছে। ফলে এখানকার অর্থনীতি হচ্ছে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। এজন্যই এদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং কৃষিখাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় পাঁচ শতাংশ।
৩। স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা
সনাতন পদ্ধতিতে চাষ আবাদের ফলে এদেশের কৃষি ব্যবস্থা আজও অনুন্নত। এজন্য কৃষিখাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। উন্নত দেশ সমূহের (যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, চীন প্রভৃতি) তুলনায় এদেশের একর প্রতি উৎপাদন প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
৪। শস্যাবর্তনের অভাব
এটি বাংলাদেশের কৃষির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদেশের দীর্ঘকাল যাবত একই জমিতে একই রকম ফসল ফলানোর কারণে জমিগুলো ক্রমশ এদের উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে একর প্রতি ফলনে খুব বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
৫। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি জমি
বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কৃষি জমি গুলো দিন দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এ দেশে পরিচালিত উত্তরাধিকার আইন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি এর জন্য বিশেষ ভাবে দায়ী। এতে চাষাবাদে বিরাট অসুবিধার সৃষ্টি হয় এবং ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৬। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশের কৃষকেরা চাষ আবাদের জন্য প্রকৃতি তথা মৌসুমী বায়ুর উপর নির্ভরশীল। তাই এদেশের কৃষিকে বলা হয় 'মৌসুমী বায়ুর জুয়া খেলা'। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সময়মত ও পরিমানমত বৃষ্টিপাত হলে দেশে কৃষিকাজে উৎপাদন বেশ ভালো হয়। আবার অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণে কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
৭। বর্গাচাষ প্রথা
বর্তমানে দেশে চাষযোগ্য জমি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বর্গাচাষ প্রথার মাধ্যমে চাষাবাদ হয়ে থাকে। এ প্রথায় কৃষকেরা অন্যের জমি তত ভালোভাবে চাষাবাদ করে না। ফলে কৃষি খাতে উৎপাদন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়।
৮। মূলধনের স্বল্পতা ও কৃষি ঋণের অভাব
কৃষিখাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন কৃষকদের নেই। এছাড়া ঋণদানের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এদেশে কম থাকায় কৃষকেরা সঠিক সময়ে সহজশর্তে প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না। ফলে, কৃষকেরা ভালোভাবে চাষাবাদ করতে পারে না বিধায় জমিতে একর প্রতি অধিক ফলন বাধাগ্রস্ত হয়।
৯। কৃষি উপকরণের অভাব
বাংলাদেশের কৃষকদের ভালো বীজ, সার প্রভৃতি সরবরাহের কোন সঠিক ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকায় কৃষিতে উৎপাদন কম হয়। এছাড়া উৎপন্ন ফসলের এক বিরাট অংশ কীটপতঙ্গ নষ্ট করে ফেলে যা প্রতিকারের জন্য ভালো কীটনাশকেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আবার শুষ্ক বা ক্ষরা মৌসুমে উন্নতমানের সেচ যন্ত্রের অভাবে ঠিকমতো সেচ দেওয়া যায় না। ফলে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় অনেক জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
১০। ভূমিহীন দুর্বল ও অশিক্ষিত কৃষক
কৃষকদের খাদ্যাভাসে পুষ্টিমান কম থাকায় তারা প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং উৎপাদনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া দেশের প্রায় অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত যাদের কৃষি বিষয়ক তেমন কোন জ্ঞান নেই বললেই চলে। ফলে কৃষিতে এর নেতিবাচক প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
১১। অনাবাদি ভূমি
বাংলাদেশের নিচু এলাকাগুলোতে (যেমন বিল, হাওর ও অন্যান্য) এখনো অনেক অনাবাদি জমির পড়ে আছে। সিলেট, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বা নাটোরে এরকম জমি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আবার সেচ ব্যবস্থার অভাবে অনেক উঁচু এলাকার ভূমিকে চাষ উপযোগী করা যাচ্ছে না।
১২। স্বয়ংভোগী কৃষি ব্যবস্থা
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই শুধুমাত্র জীবন ধারণের জন্য চাষাবাদ করে থাকে। উন্নত দেশ সমূহের (যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য উন্নতদেশ) কৃষকরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যেরূপ কৃষি কাজ করে, এদেশের কৃষকেরা সেরুপ করে না। কারণ দরিদ্র কৃষকেরা তাদের পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মিটানোর পর অবশিষ্ট জমিতে অর্থকারী ফসলের চাষাবাদ করে থাকে।
১৩। দুর্যোগ কবলিত কৃষি
বাংলাদেশের কৃষি প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির কবলে পতিত হয়। ফলে দুর্যোগ প্রবণতা এদেশের কৃষির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এমনকি কোন কোন বছর রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ফেনী প্রভৃতি জেলায় একাধিকবারও ফসল নষ্ট হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে এদেশের কৃষির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তবে বন্যা পরবর্তী সময়ের জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হলে এবং উপযুক্ত মৌসুম বিদ্যমান থাকলে, বন্যার সাথে চলে আসা পলিমাটিতে বেশ ভালো ফসল ফলানো যায়।
ওপরে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বাদেও বাংলাদেশের কৃষিতে যেসব বৈশিষ্ট্য গুলো দেখা যায় তা হল বেকার, শ্রমনিবিড়, প্রযুক্তি, কীট-পতঙ্গের উপদ্রব, এক ফসলি উৎপাদন, অদক্ষ কৃষিশ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক ইত্যাদি।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষিতে খাদ্যশস্যের চাষাবাদ একটি লক্ষণীয় বিষয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্থাৎ অর্থকারী ফসলের চাষ খাদ্যশস্যের তুলনায় খুব কম হয়ে থাকে। তার কারণে বলা যায়, এ দেশে চাষাবাদের সাথে জড়িত কৃষক শ্রেণীর লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরীব এবং তারা নিজেদের খাদ্যের চাহিদা বা প্রয়োজন মিটানোর নিমিত্তেই প্রধানত খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে দেখা যায়। সুতরাং উপরোক্ত বিষয়গুলো বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা যায়।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url