স্থানান্তরিত কৃষি এর শ্রেণীবিভাগ এবং বৈশিষ্ট্য সমূহ
প্রিয় পাঠক, স্থানান্তরিত কৃষি এর শ্রেণীবিভাগ এবং বৈশিষ্ট্য সমূহ সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী, এর সম্পর্কিত বিষয়ে সঠিক তথ্য কোথায় পাবেন এই নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই পোস্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের এই প্রতিবেদনে স্থানান্তরিত কৃষির সংজ্ঞা, স্থানান্তরিত কৃষির নামকরণ, স্থানান্তরিত কৃষির শ্রেণীবিভাগ, স্থানান্তরিত কৃষির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমূহ ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন বিস্তারিত তথ্য পাবেন ইনশাআল্লাহ।
ভূমিকা
স্থানান্তরিত কৃষি হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ফসল ফলানোর পদ্ধতি। এটি সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি। মানব জীবনে কৃষির আবির্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ গাছ থেকে ডালপালা বা পাথর ধারালো করে নিজের পেশি শক্তির সাহায্য মাটি খুড়ে বীজ বপন করে ফসল ফলাতো। বারবার ফসল উৎপাদনের পর স্থান পরিবর্তন করে সম্পূর্ণরূপে একটি নতুন জায়গায় ভূমি তৈরীর মাধ্যমে নতুন করে কৃষিকাজ করা হতো। ফসল উৎপাদনের এই প্রাচীন বা আদিম রীতিই স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি নামে অভিহিত। মানব জীবনের সবচেয়ে প্রাচীন পর্যায়ের পদ্ধতি গুলোর মধ্যে স্থানান্তরিত কৃষি উল্লেখযোগ্য।
স্থানান্তরিত কৃষির উৎপত্তিকাল (Origin of Shifting Agriculture)
সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই স্থানান্তরিত কৃষির প্রচলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে রেডিওকার্বন ব্যাখ্যা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, নব্য প্রস্তর যুগে ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিম্ন অক্ষাংশের আর্দ্র নিম্নভূমিতে স্থানান্তরিত কৃষির উৎপত্তি হয়েছিল। এ সময়টি ছিল মানুষের খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি থেকে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে পরিবর্তন কাল।
স্থানান্তরিত কৃষির সংজ্ঞা (Definition of Shifting Agriculture)
কোন ভূমির উর্বরতা শক্তি সঠিক ভাবে বজায় রাখার জন্য এক বা একাধিক ফসল উৎপাদনের পর ওই ভূমি পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভূমিতে গিয়ে ফসল ফলানোর পদ্ধতিকে স্থানান্তরিত কৃষি বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ও ভূগোলবিদ স্থানান্তরিত কৃষিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি সংখ্যা উল্লেখযোগ্য যেমন-
১। জনস ও ডারকেনওয়াল্ড (Jones & Darkenwald, 1964) বলেন," কোন স্থানে দুই বা ততোধিক বছর ফসল উৎপাদনের পর সেই স্থান পরিবর্তন করে অন্য কোন স্থানে চাষাবাদ করাকে স্থানান্তরিত কৃষি বলা হয়।" তারা স্থানান্তরিত কৃষিকে Migratory Primitive Agriculture হিসেবে বিবেচনা করেন।
২। বেলজার (Beljer, 1963) বলেন," কৃষি ক্ষেত্রে কৃষক যখন কৃষি ভূমি ও নিজস্ব বাসস্থান উভয়ই পরিবর্তন করে কৃষি কার্য সম্পাদন করে থাকে, তখন তাকে স্থানান্তরিত কৃষি বলা হয়। তবে এই কৃষিতে ভূমি আবর্তনের চেয়ে শস্যাবর্তনই বেশি হয়ে থাকে।"
৩। কার্ল ও সাওয়ার (Karl-o-Saur, 1969) বলেন, স্থান পরিবর্তনকারী স্থানান্তরিত কৃষি হিসেবে বহুল পরিচিত। এটি কৃষির প্রাচীনতম অর্থনৈতিক অবস্থা।"
৪। ইউনেস্কো কমিশন (UNESCO, 1989) এর মতে," যে কৃষি ব্যবস্থায় চাষাবাদের জমিগুলো পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষক বা চাষীদের বাসস্থানেরও পরিবর্তন হয় তাকে স্থানান্তরিত কৃষি বলে।"
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, স্থান পরিবর্তনকারী কৃষি ব্যবস্থাই মূলত স্থানান্তরিত কৃষি।
স্থানান্তরিত কৃষির নামকরণ (Naming Shifting Agriculture)
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানান্তরিত কৃষি বিভিন্ন নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিকভাবে এই কৃষি স্লাশ এন্ড বার্ন (Slash and Burn), বুশ ফেলো (Bush fallow), সুইডেন কাল্টিভেশন (Swiden Cultivation) প্রভৃতি নামে বিশেষ পরিচিত। এছাড়াও বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতে জুম (Jum), উপদ্বীপীয় ভারত কুমারী ও পশু (Kumari & Pashu), জাপান কাইডেন (Kaiden), ব্রাজিলের রোকা (Roca), শ্রীলঙ্কায় চেনা (Chena) ইত্যাদি নামে পরিচিত।
স্থানান্তরিত কৃষির শ্রেণী বিন্যাস (Classification of Shifting Agriculture)
বিভিন্নভাবে স্থানান্তরিত কৃষির শ্রেণীবিভাগ করা যায়। বসতির শ্রেণীবিন্যাসের উপর ভিত্তি করে স্থানান্তরিত কৃষিকে তিন টিশ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো-
১। যাযাবরীয় বা বসতিহীন স্থানান্তরিত কৃষি,
২। অস্থায়ী বসতির স্থানান্তরিত কৃষি এবং
৩। স্থায়ী বসতির স্থানান্তরিত কৃষি।
এগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১। যাযাবরীয় বা বসতিহীন স্থানান্তরিত কৃষি
এ কৃষি ব্যবস্থাই কৃষকেরা পশু শিকার ও ফলমূল সংগ্রহের জন্য বিভিন্নভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং খাদ্যদ্রব্যের পরিপূরক সংস্থান হিসেবে এ ধরনের কৃষি কাজ করে থাকে। এজন্য এটি যাযাবরীয় স্থানান্তরিত কৃষি হিসেবে বহুল পরিচিত।
২। অস্থায়ী বসতির স্থানান্তরিত কৃষি
এখানে কৃষকেরা ফসলের মৌসুমে তদারকি করার জন্য অস্থায়ী বসতি নির্মাণ করে। অতঃপর ফসল তোলা হয়ে গেলে পুনরায় বাড়ি চলে যায়।
৩। স্থায়ী বসতির স্থানান্তরিত কৃষি
এ কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকেরা স্থায়ীভাবে ফসলের ক্ষেতের কাছে বসতি স্থাপন করে এবং আশেপাশে এলাকায় চাষাবাদ করে। এ কৃষিতে তারা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া বসতি পরিবর্তন করে না।
স্থানান্তরিত কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহ
প্রতিটি কৃষির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তদ্রূপ স্থানান্তরিত কৃষির ও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রাকৃতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ভেদে এদের বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। স্থানান্তরিত কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহকে প্রধানত ৪ টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১। সাধারন বৈশিষ্ট্য (Generail Characteristics),
২। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য (Physical Characteristics),
৩। সামাজিক বৈশিষ্ট্য (Social Characteristics),
৪। অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য (Economic Characteristics)।
১। স্থানান্তরিত কৃষির সাধারন বৈশিষ্ট্য (Generail Characteristics)
স্থানান্তরিত কৃষির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর অবস্থা, কৌশল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। স্থানান্তরিত কৃষির বৈশিষ্ট্য সমূহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। নির্ণয় এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
(I) স্থানান্তরিত কৃষির পর্যায়ক্রমিক অবস্থা
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত কৃষির পর্যায়ক্রমে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও সর্বজনীন এই কৃষির জন্য কতগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এগুলো হলো-
- কৃষিকাজের জন্য নির্বাচিত ভূমির গাছগুলোকে কেটে ও পুড়িয়ে উক্ত ভূমিকে চাষ উপযোগী করা হয়।
- নির্বাচিত ভূমিকে ৫ - ৬ বছর শস্য উৎপাদন করার পর অন্য কোন নতুন স্থানে গিয়ে একই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়।
- প্রায় ৬ থেকে বছর ১২ বছর পর পূর্ববর্তী স্থানে ফিরে এসে পুনরায় চাষাবাদ করা হয়।
(II) উৎপাদন কৌশল
এ কৃষির যন্ত্রপাতিগুলো খুব আদিম। এগুলোর সাহায্যে পর পর গর্ত করা হয়। প্রতি গর্তে সাধারণত একসাথে কয়েক ধরনের ফসলের বীজ বহন করা হয়। বীজ বপন অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত বর্ষা আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। পরিপক্ক ফসল বিভিন্ন সময়ে কাটা হয়।
(III) যন্ত্রপাতির ব্যবহার
এ কৃষিতে দীর্ঘ সময় যাবত একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে মানুষ পেশী শক্তির সাহায্যে কৃষিকাজ সম্পন্ন করে থাকে। প্রাচীনকালে এই কৃষিতে যেমন আগুন ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে ও তার ব্যবহার করা হয়। এ কৃষিতে বর্তমানে অনেকটা উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। আদিম সময়ের যন্ত্রপাতির মধ্যে ধারালো কাঠি, খননদন্ড, কাস্তে, পাথরের কাস্তে, নিড়ানি, কোদাল প্রভৃতি অন্যতম। আবার আধুনিক সময়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মধ্যে গর্ত খননকারী লাঠি, লোহার হাতিয়ার, উন্নত নিড়ানি, গাইতি প্রভৃতি অন্যতম।
২। স্থানান্তরিত কৃষির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য (Physical Characteristics)
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিষয়সমূহ যা স্থানান্তরিত কৃষিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। স্থানান্তর কৃষিতে যেসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো-
(I) ভূপ্রকৃতি
কোন এলাকা ভূপ্রকৃতি স্থানান্তর কৃষির সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত। কারণ উপত্যকা সাথে যুক্ত ঢাল গুলো একসাথে করে ফসল ফলানো হয়। এজন্য পাহাড়ের ঢালগুলো কেটে চত্বর তৈরি করে ফসল বপন করা হয়। ক্রান্তীয় আর্দ্র অঞ্চলের নিম্নভূমি সাধারণত স্যাঁতস্যেতে থাকে। ফলে এরূপ ভূমিতে স্থানান্তরিত কৃষিকাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য।
(II) তাপমাত্রা
এ কৃষিব্যবস্থা নিরক্ষরেখার উভয়দিকে ২০ ডিগ্রি উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের উষ্ণ মন্ডলে দেখা যায়। তুষারপাত বিশিষ্ট ও শীতল উচ্চ অক্ষাংশে এ কৃষি ভালো হয় না। স্বল্পকালীন শীতঋতুবিশিষ্ট এলাকায় এই কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
(III) বৃষ্টিপাত
স্থানান্তরিত কৃষি এলাকাগুলো বিশেষভাবে আর্দ্র। এ অঞ্চলে ২০ ইঞ্চির কম বৃষ্টিপাত হয় না। কোন অঞ্চলের ৬০ ইঞ্চি আবার আমাজন ও কঙ্গো অববাহিকা এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৮০ ইঞ্চির অধিক বৃষ্টিপাত হয়। আর্দ্র মৃত্তিকা ও উষ্ণ আবহাওয়া এ কৃষির বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে অন্যতম।
(IV) মৃত্তিকা
জৈববস্তুর সঞ্চয় ধীরগতি সম্পন্ন বিধায় বেশিরভাগ বনভূমির মৃত্তিকা উদ্ভিদের পুষ্টির জন্য বিশেষ উপযোগী নয়। এরূপ মৃত্তিকায় পুষ্টিকারক পদার্থের অভাব থাকে। এছাড়াও এ ধরনের মৃত্তিকায় উদ্ভিদ ধ্বংসকারী জীবাণু থাকে। ডালপালা ও লতাপাতা পোড়ানোর ফলে ওইসব জীবাণু নষ্ট হয়ে মৃত্তিকার উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এখানে বনভূমি পুড়িয়ে ছাইকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
(V) উদ্ভিদ
ক্রান্তীয় শ্রীহরিৎ বনভূমি অঞ্চলে সাধারণত এ ধরনের চাষাবাদ দেখা যায়। অধিক গাছপালা থাকলে সহজে পরিষ্কার করা যায় না। এজন্য কম গাছপালা বিশিষ্ট এলাকা স্থানান্তরিত কৃষির জন্য বিশেষ উপযোগী।
৩। স্থানান্তরিত কৃষির সামাজিক বৈশিষ্ট্য (Social Characteristics)
সামাজিক বৈশিষ্ট্য বলতে সমাজের রীতি নীতি কে বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, ভূমির আয়তন শস্যাবর্তন ইত্যাদি সামাজিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে থাকে। স্থানান্তরিত কৃষির সামাজিক বৈশিষ্ট সমাবেশ চমকপ্রদ। নিম্নে গুলো বর্ণনা করা হলো-
(I) ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা
ভূমি পরিবর্তনকারী চাষাবাদের জন্য বড় বড় ভূখণ্ডের প্রয়োজন হয়। এ কৃষিতে ভূমির প্রাকৃতিক অবয়ব দ্বারা প্রতিবেশী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সীমানা নির্ধারিত হয়। উপজাতীয় প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে ভূমি বন্টন করে থাকে। প্রত্যেক সদস্যের নিজ নিজ ভূমির উপর অধিকার বজায় থাকে।
(II) স্থানান্তরিত কৃষির কার্যক্রম সমূহ
শস্য বপন থেকে শুরু করে ঘরে ওঠানো পর্যন্ত এই কৃষি কাজে নিয়োজিত কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় নীতিমালা ও অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকে। যথা-
- পাহাড়ি এলাকায় বনভূমি নির্বাচন করা হয়,
- বনভূমি কেটে পরিষ্কার করার পর শুষ্ক বনভূমি ছাই এ পরিণত করা হয়,
- অধিক ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়,
- খনন কার্যের পর ফসল বপন করা হয়,
- নিড়ানের মাধ্যমে ফসলের পরিচর্যা করা হয়,
- শস্য সংগ্রহের পর মাড়াই করা হয়,
- সবশেষে ফসল ঘরে তুলে নবান্ন বা নতুন আনন্দ-উৎসব পালন করা হয়।
(III) বাংলাদেশের স্থানান্তরিত কৃষি
এটি এ দেশের জুম চাষ হিসাবে বহুল পরিচিত। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতীয়দের মধ্যে এ ধরনের কৃষিকাজ প্রচলন দেখা যায়। এখানকার কার্যক্রম সমূহ নিম্নরূপ-
- জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাস সময় পাহাড়ি বনভূমি পরিষ্কার করা হয়,
- লতাপাতাও ডালপালা পোড়ানোর মাধ্যমে জমিতে ছাই ছিটানো ও জমি চাষ উপযোগী,
- সাধারণত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সময়ের মধ্যে জমি থেকে বিভিন্ন ধরনের ফসল সংগ্রহ করা হয়।
(IV) উল্লেখযোগ্য ফসল
এখানে উৎপন্ন বিভিন্ন ফসলের মধ্যে আদা, তুলা, মশিনা বীজ, তিসিবীজ, সরিষা বীজ, আনারস, ধান অন্যতম প্রভৃতি অন্যতম।
(V) ভূমির আবর্তন
স্থানান্তর কৃষিতে দুই ধরনের ভূমির আবর্তন দেখা যায় যথা-
A. দীর্ঘমেয়াদে আবর্তন
- এ আবর্তন চক্রে মোট সময়ে ৫০ বছর ও পুনঃপূর্ণ গৃহ পরিবর্তন। এতে প্রায় ৩৫ বছর চাষাবাদ করা হয় এবং ১৫ বছর অনবধি থাকে।
- আবর্তন চক্রের মোট সময় প্রায় ২০ বছর দীর্ঘস্থায়ী বাড়ি এবং ৩০ বছর স্থায়ী বাড়ি দেখা যায়।
B. স্বল্প মেয়াদি আবর্তন
এই আবর্তন চক্রের প্রায় ৩ বছর ফসল উৎপাদন ও পরের তিন বছর অনাবাদি থাকে। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও মৃত্তিকার চুয়ান প্রক্রিয়ার ফলে ভূমির ওপরিতলের মৃত্তিকার পুস্তিকার পদার্থ যথেষ্ট পরিমাণে বিনষ্ট হয়। ফলে এইরূপ মাটিতে উদ্ভিদের পুষ্টিকর অভাব দেখা দেয় এবং ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে পতিত অবস্থায় ফেলে রেখে মৃত্তিকার উর্বর শক্তি পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে ভূমি চাষ ও আবর্তন চক্র সংক্ষিপ্ত হয়ে এলে এবং জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে মৃত্তিকার পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে যথেষ্ট সময় পাইনা। কারণ বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে ভূমিতে চাষাবাদ করতে বাধ্য হয়।
(VI) শস্যাবর্তন
বাংলাদেশে সামান্য পরিমাণ এবং ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শস্যাবর্তন পদ্ধতি বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়। সেখানে প্রথম বছরে খরিফ মৌসুমে মেইজি, লিটন, বাজরা, জোয়ার, আদা, আলু, তামাক প্রভৃতি এবং দ্বিতীয় বছরে খরিফ মৌসুমে ধান ও রবি মৌসুমে ক্ষুদ্রাকৃতি দানা বিশিষ্ট শস্য চাষাবাদ করা হয়। কোন কোন বছর রবি মৌসুমে বিভিন্ন সবজি এবং খরিফ মৌসুমে ফুটি, বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস প্রভৃত উৎপাদন করা হয়।
৪। স্থানান্তরিত কৃষির অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য (Economic Characteristics)
স্থানান্তরিত কৃষির অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(I) ফসল
এ কৃষি ব্যবস্থায় এশিয়ার ধান, আফ্রিকার জোয়ার, উভয় আমেরিকার বাজরা প্রধান শস্য। এছাড়া শশা, কুমড়া, মোটর, সিম, লাউ, টমেটো, আলু, আদা, তুলা, আনারস প্রভৃতি উৎপন্ন হয়।
(II) পশু পালন
সাধারণত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষ প্রভৃতি স্থানান্তরিত কৃষি অঞ্চলের গৃহপালিত পশু। ফলে দুধ, মাংস, মাখন, ডিম প্রভৃতি এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত।
(III) শিকার
এ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য বন থেকে কাঠ, শন, বাশ প্রভৃতি সংগ্রহ করে থাকে।
(IV) ব্যবসা-বাণিজ্য
প্রাচীনকালে স্থানান্তরিত কৃষকেরা কৃষি থেকে প্রাপ্ত সামগ্রীগুলো শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করত। ফলে সে সময় উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য ও ফসল নিজ নিজ গোত্র বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য দ্রব্যের অতিরিক্ত রপ্তানি করা হয়। বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যে মধু, মম, সুপারি, আটা, সুগন্ধি, রং ও সিঙ্কোনা অন্যতম।
(V) বাগান কৃষি
বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত কৃষিতে বাগান কৃষি একটি অন্যতম সংযোজন। এক্ষেত্রে অ্যাঙ্গালো আমেরিকানরা স্থানান্তরিত কৃষি এলাকায় রাবার, পাইন প্রভৃতি বাগান কৃষির উদ্ভিদ রোপনের জন্য অধিক পরিমাণে পুজী বিনিয়োগ করে চলেছে।
(VI) অভিগমন
বিদেশী অনেক লোক স্থায়ী অভিগমনের মাধ্যমে আবাদি কৃষি এলাকায় এসে বসবাস করে থাকে। বর্তমানে ব্রাজিল এ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাপানি, আফ্রিকার কেনিয়া ও ঘানায় বহু সংখ্যক ইউরোপীয় এবং ক্রান্তীয় আফ্রিকায় লক্ষাধিক ভারতীয় এসে বসবাস করছে।
স্থানান্তরিত কৃষির সুবিধাবলি
স্থানান্তরিত কৃষির উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- পারিবারিকভাবে চাষাবাদ করা হয় বিধায় কায়িক শ্রমই যথেষ্ট। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তেমন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না।
- এতে অল্প পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়।
- একসাথে একাধিক ফসল চাষাবাদ করা হয়।
- এ কৃষিতে খুব কম সংখ্যক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।
- সার প্রয়োগে বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় না।
- ঘরবাড়ি নির্মাণে খুব কম খরচ হয়।
স্থানান্তরিত কৃষির অসুবিধা সমূহ
- স্থানান্তরিত কৃষির অন্যতম প্রধান অসুবিধা হচ্ছে, কৃষি ভূমির ঊর্বরতা শক্তির হ্রাস পাওয়া। পূর্বে যেখানে ২৫-৩০ বছর অন্তর অন্তর একই জমিকে চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি ৪-৫ বছর পর পর একই জমিতে চাষাবাদ এর জন্য ব্যবহার করা হয়, ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
- স্থানান্তরিত কৃষি কাজে বন উজার, ভূমিক্ষয়, বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। এজন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই কৃষিকে একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- ভূমির উপর অতিরিক্ত চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- দিন দিন প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
- বন জঙ্গল ও ঝোপঝাড় উজাড় হাওয়াই বন্যপ্রাণীর সংখ্যার হ্রাস পাচ্ছে।
উপসংহার
বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলশ্রুতিতে স্থানান্তরিত কৃষিব্যবস্থার সাথে আধুনিক যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সংযোজন করে এ কৃষির ব্যাপক উন্নতি সাধন করা সম্ভবপর হয়েছে। ক্রান্তীয় এলাকায় ৩ চতুর্থাংশ মানুষ এই পদ্ধতিতে চাষ আবাদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। তবে অনেকের মতে, এটি আদিম ও অলাভজনক কৃষি এবং মৃত্তিকা ক্ষয়, বন ও বন্যপ্রাণী উজাড়, পানি সম্পদ প্রভৃতি অপচয়ের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করেছে। তাই এই কৃষি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করতে হলে আরো ব্যাপক গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বিশেষজ্ঞগণের মতে, সঠিক গবেষণায় এই কৃষিকে আরও এক ধাপ উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url