হুইটলেসির কৃষির শ্রেণীবিভাগ আলোচনা

প্রিয় পাঠক, হুইটলেসির কৃষির শ্রেণীবিভাগ আলোচনা সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে খুব আগ্রহী, কোন বইটি অনুসরণ করবেন এই নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হুইটলেসির কৃষির শ্রেণীবিভাগ আলোচনা

আজকের এই প্রতিবেদনে কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ, কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগের নিয়ামক সমূহ, কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগের উপাদান ও প্রভাবক সমূহ, হুইটলেসি কৃষি শ্রেণীবিভাগ সমূহ সহ আরো অনেক বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। ধৈর্যের সহিত শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

ভূমিকা

পৃথিবীতে বসবাসরত প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটিরও অনেক বেশি নানা বর্ণের মানুষ বিভিন্নভাবে ভূমিকে ব্যবহার করে চলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে ভূমির ওপর অধিক চাপ পড়েছে। এতে ফসলি ভূমি, পশুপালন প্রভৃতিতে ব্যাপক এলাকা দখল হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পশু পালন ও ফসল উৎপাদন উভয়ই কৃষি কাজের অন্তর্ভুক্ত।

কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ (Classification in Agriculture Region)

কৃষির উৎপত্তির পর থেকেই বিভিন্ন গুণীজন কৃষি কাজে নিয়োজিত ভূমিগুলোর শ্রেণী বিভাজনের চেষ্টা করে আসছেন। তাদের মধ্যে এডওয়ার্ড হার্ন জলবায়ু অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে কৃষির সার্থক শ্রেণী বিভাজনের জোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তা ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি। অতঃপর ১৯২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভূগোল সাময়িক ও জার্নালে বিভিন্ন মহাদেশের কৃষি অঞ্চলের ওপর পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে জনাসন ইউরোপকে, ব্যাকার উত্তর আমেরিকাকে এবং জন দক্ষিণ আমেরিকাকে বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে শ্রেণীবিভাজন করেন। এছাড়া টেলর অস্ট্রেলিয়াকে এবং ভলকেনবার্গ এশিয়াকে বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে শ্রেণীবিভাজন করেন।

অতঃপর হুইটলেসি অত্যন্ত সফলভাবে বিশ্বের প্রধান কৃষি পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করে তা মানচিত্রে প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে শাটর্জ আফ্রিকা মহাদেশকে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং সাইমন কৃষির পারিশরিক বিন্যাসের ভিত্তিতে বিশ্ব কৃষির শ্রেণীবিভাজন করেন। উল্লেখিত এসব শ্রেণীবিভাজনের মধ্যে হুইটলেসির শ্রেণী বিভাজনই সর্বমহলের সার্থক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাই কৃষিবিদ সহ অপরাপর সবাই আজও তার এ শ্রেণীবিভাজন অনুসরণ করে থাকেন।

কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগের নিয়মক (Factors of Classification in Agriculture Region)

কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগের জন্য প্রধানত দুইটি নিয়ামক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। যথা-
১। মানুষ ও পরিবেশের সাথে সমতা বিধান,
২। কমপক্ষে একটি ফসল উৎপাদনের পক্ষে সহায়ক নিয়ামক সমূহ, যেমন-জলবায়ু, মৃত্তিকা, ভূমির ঢাল, অর্থনৈতিক উপাদান, জনসংখ্যার ঐতিহ্য, প্রযুক্তি প্রভৃতি।

কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগের উপাদান ও প্রভাবক (Element and Influencer of Classification of Agriculture Region)

পৃথিবীকে বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুণীজন বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালান। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ প্রচেষ্টা ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। অবশেষে হুইটলেসি সতর্কতার সাথে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৫ টি উপাদান ও প্রভাবকের উদ্ভাবন করেন। যথা-
১। শস্য ও পশুর সমন্বয়,
২। শস্য উৎপাদন ও পশুপালন পদ্ধতির সমন্বয়,
৩। ভূমি শ্রম মূলধন ও সংস্থার কার্যাবলীর প্রসারতা
৪। উৎপাদন ও ভোগের ধরন, এবং
৫। ভূমির কৃষি প্রযুক্তিগত ব্যবহার ও উৎপাদিত শস্যের গুদামজাতকরণ প্রক্রিয়া।

হুইটলেসির কৃষি বিভাজিত অঞ্চল (Whittlesey's Agricultural Classification)

আমেরিকান জার্নাল অর্থনৈতিক ভূগোলে হুইটলেসি সিরিজ আকারে বিশ্ব কৃষি অঞ্চল প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। পৃথিবীর সমস্ত কৃষি অঞ্চলের গবাদিপশু, শাকসবজি ও শস্যের সমন্বয় সাধন করে ৫ টি বৃহত্তর কৃষি অঞ্চলের পরিকল্পনা করেন। যথা-
১। বন্ধুর অঞ্চলের প্রসাচারণ এলাকা,
২। প্রধান শস্য উৎপাদনকারী অঞ্চল ও সমন্বিত পশুসমূহ,
৩। শস্য প্রাধান্য বিস্তারকারী অঞ্চল ও নির্ভরশীল গবাদিপশু সমূহ,
৪। শস্য ও প্রাণীর সমমূল্যায়ন, এবং
৫। উদ্যান কৃষি অঞ্চল।

উপরোক্ত ৫ টি শ্রেণীবিভাগে বিশ্ব কৃষি অঞ্চল নির্ধারণে জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায় হুইটলেসি তার শ্রেণীবিভাগকে সর্বসাধারণের কাছে সহজে বোধগম্য করানোর জন্য ১৩ টি ভাগে বিভক্ত করেন। এগুলো হলো-

১। যাযাবরীয় পশুপালন (Nomadic Herding) ,
২। গবাদি পশু চারণ (Livestock Ranching) ,
৩। স্থানান্তরিত কৃষি (Shifting Cultivation) ,
৪। আদিম স্থানীয় কৃষি (Rudementary Local Cultivation) ,
৫। নিবিড় স্বপ্রয়োজনীয় কৃষি (ধানসহ) (Intensive Subsistance Agriculture with Paddy) .
৬। নিবিড় স্বপ্রয়োজনীয় কৃষি (ধান বিহীন) (Intensive Subsistance Agriculture without Paddy) .
৭। বাণিজ্যিক আবাদি (বাগান) কৃষি (Commercial Plantation Agriculture) ,
৮। বাণিজ্যিক শস্য কৃষি (Commercial Grain Farming),
৯। ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি (Mediterranean Agriculture) ,
১০। বাণিজ্যিক পশুপালন ও মিশ্র কৃষি (Commercial Livestock & Crop Farming) ,
১১। জীবিকা নির্বাহী চাষ ও পশুপালন (Subsistance Crop & Livestock Farming) ,
১২। বাণিজ্যিক দুগ্ধ খামার (Commercial Dariy Farming) ,
১৩। বিশেষায়িত উদ্যান কৃষি (Specialized Horticulture)।

১। যাযাবরীয় পশুপালন (Nomadic Herding)

যাযাবর পশু পালন পদ্ধতিকে প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাধারণত প্রায় শুষ্ক অঞ্চলে ভেড়া, ছাগল এবং মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে বলগা হরিণ যাযাবরদের প্রধান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবর পরিবারেরা পাঁচ থেকে ছয়টি পরিবার একত্রে স্থান পরিবর্তন করে। প্রতিটি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ২৫ থেকে ৬০ টি ছাগল ও ভেড়া এবং 10 থেকে 15 টি উট থাকে। পানি এবং তৃণভূমির উপর নির্ভর করে যাযাবরেরা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ায়। যাযাবর পশুপালন পদ্ধতি তিনটি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। যথা-

(I) মধ্য এশিয়া (Middle Asia)

মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, সিকিয়াম, রাশিয়া, তুর্কিস্তান এবং কিরিগিজ উপত্যকা এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলের কাজারু, মঙ্গল ও কিরগিজদের অধিকাংশই যাযাবর পশু পালন করে থাকে। মধ্য এশিয়ার জলবায়ু, মৃত্তিকা ও প্রাকৃতিক ঘাসের বৈচিত্রের জন্য এই এলাকায় স্থায়ী চাষাবাদ কখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে উক্ত অঞ্চলে যাযাবর জাতি পরিবার দ্বারা অধিকৃত হয়েছে।

(II) দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা (South-West Asia and North Africa)

ইরাক, ইরান, সৌদিআরব, আনাতোলিয়া মালভূমি, সুদান, সাহারা মালভূমি ও পূর্ব আফ্রিকার উচ্চ এলাকা এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এ অঞ্চলের ছোট ছোট উদ্ভিদ তৃণ জন্মায়। বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য এ অঞ্চলে শুধুমাত্র ছাগল, ভেড়া, উট প্রভৃতি প্রতিপালন করা হয়। এই এলাকা পৃথিবীর অন্যতম মেষচারণ এলাকা হিসেবে অভিহিত।

(III) শীতল অঞ্চল (Cold Area)

তুন্দ্রা অঞ্চলের দক্ষিণে ল্যাপজাতীয় শীতল অঞ্চলে যাযাবর অধিবাসীদের বসবাস। স্বল্পকালীন গ্রীষ্মের সময় তন্দ্রার বন্দর এলাকায় নতুন জন্মানো তৃণক্ষেত্রে বসবাস করে কিন্তু শীতকালে পর্ণমোচী অরণ্য ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রচন্ড শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ যাযাবর অধিবাসীরা তাদের পরিবার সহ বিভিন্ন দেশ যেমন- নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায়।

২। গবাদি পশু চারণ (Livestock Ranching)

মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে যেখানে সাধারণত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫ থেকে ৭৫ সেমি এমন এলাকায় পশুচরণ ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক পশুচারণ প্রধানত মধ্যে অক্ষাংশীয়, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আমেরিকা, গ্রেটব্রিটেন এবং আন্দিজ সমভূমি ও মালভূমিতে গড়ে উঠেছে।

উত্তর আমেরিকার মধ্যে অক্ষাংশীয় অঞ্চলের আমেরিকার, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশ, কানাডা ও উত্তর মেক্সিকোর সমভূমিতে গড়ে ওঠা তৃণভূমিকে পেইরি বলে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত বাণিজ্যিক পশুচারণ এলাকা। এখানে ফ্রিশিয়ানা, জার্সি প্রভৃতি উন্নত মানের গবাদিপশু প্রতিপালন করা হয়।

দক্ষিণ আমেরিকার, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, দক্ষিণ ব্রাজিল, পাটাাগুনিয়া, গুটিমেরা প্রভৃতি অঞ্চল পশু চালানোর জন্য বিখ্যাত। এ অঞ্চলের তৃণভূমিকে পম্পাস বলে। আর্জেন্টিনা পৃথিবীর মোট গবাদিপশুর এক-পঞ্চমাংশ লালন পালন করে থাকে।

অস্ট্রেলিয়ার মোট ভেড়ার সংখ্যা গড়ে ১৬ কোটি। পৃথিবীর মোট উল রপ্তানির অর্ধেক অস্ট্রেলিয়া থেকে আসে। কুইজল্যান্ড, নিউসাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া প্রভৃতি পশু চারণক্ষেত্র। নিউজিল্যান্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রগতি একমাত্র পশুচারণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এদেশে মাথাপিছু ২ টি গরু ও ১০ টি ভেড়া রয়েছে।

৩। স্থানান্তরিত কৃষি (Shifting Cultivation)

স্থানান্তরিত কৃষিকে ভ্রাম্যমান কৃষি ও বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে এ কৃষি ব্যবস্থায় লৌহনির্মিত খননদন্ড, শাবল প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়। স্থানান্তরিত কৃষি মধ্য আফ্রিকার ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল অরণ্যভূমি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত কৃষি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন-ইন্দোনেশিয়াতে লাডেং, ফিলিপাইন ও মধ্য আমেরিকায় মিলপাও, ভিয়েতনামের রায়, ব্রাজিলের রোকা, মধ্য আফ্রিকাতে মোসুট এবং বাংলাদেশ ও ভারতের ঝুম পদ্ধতি। স্থানান্তরিত কৃষি ব্যবস্থায় ফসল চক্রের পরিবর্তে ভূমির আবর্তন ঘটে থাকে।

৪। আদিম স্থানীয় কৃষি (Rudementary Local Cultivation)

যেসব অঞ্চলে স্থানান্তরিত কৃষি ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, সেখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে কোন কোন এলাকায় আদিবাসীরা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। উক্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা ও জলবায়ু অনুকূল থাকলে তারা স্থায়ীভাবে চাষাবাদের প্রচলন করে। জমির উর্বরতা শক্তি কমে গেলে তারা সার প্রয়োগ না করে কোকো, পামওয়েল, রবার প্রভৃতি বাণিজ্যিক ফসল চাষাবাদ করে থাকে।

৫। নিবিড় স্বপ্রয়োজনীয় কৃষি (ধানসহ) (Intensive Subsistance Agriculture with Paddy)

ধান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীবনধারণের প্রধান খাদ্য। সাধারণত আদ্র ঋতুতে ধান চাষ হয়। এ অঞ্চলের ব-দ্বীপ, প্লাবনভূমি, উপকূলীয় সমভূমি এবং চত্বর এলাকায় ধানের আবাদ হয়। ধানের সাথে বৃক্ষ জাতীয় ফসলেরও চাষ করা হয়। এ কৃষি পদ্ধতি অধিকাংশই প্রাচীন।

৬। নিবিড় স্বপ্রয়োজনীয় কৃষি (ধান বিহীন) (Intensive Subsistance Agriculture without Paddy)

যেসব অঞ্চলের লোক বসতি ঘন অথচ ধান উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা নেই, সেখানে তুষার ও শুষ্কতা সহ্যকারী ফসল ও বৃক্ষলতা ফসল উৎপাদন করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, মিশরের মরুদদ্যানে এ কৃষি পদ্ধতি প্রসার লাভ করেছে।

৭। বাণিজ্যিক আবাদি (বাগান) কৃষি (Commercial Plantation Agriculture)

পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন এ কৃষি অঞ্চলের প্রধান লক্ষ্য। এ অঞ্চলের খামারে যান্ত্রিক কৃষি, উন্নতমানের সার ও বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন করা হয়। চা, ইক্ষু, কফি, কোকো, রবার প্রভৃতি বাণিজ্যিক আবাদিক কৃষির অন্তর্ভুক্ত।

৮। বাণিজ্যিক শস্য কৃষি (Commercial Grain Farming)

ইস্পাতের লাঙ্গল, ফসল কাটার যন্ত্র, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতি ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য ফসল উৎপাদনই এ কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য। উৎপাদিত শস্যের মধ্যে গম প্রধান। উত্তর আমেরিকা, রাশিয়া, আর্জেন্টিনায় এই কৃষি ব্যবস্থায়ী প্রচলন আছে।

৯। ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি (Mediterranean Agriculture)

ভূমধ্যসাগরীয় দেশ সমূহে পর্বত বহল ভূপ্রকৃতি এবং ভিন্নধর্মী জলবায়ুর জন্য উৎপাদিত ফসল ও ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে শীতকালে বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করে এবং গ্রীষ্মকালে সেচের পানির সাহায্যে ফসল উৎপাদন করা হয়। গবাদিপশু সমূহ শীতকালে নিম্নভূমিতে এবং গ্রীষ্মকালে উচ্চভূমিতে চারণ করা হয়।

১০। বাণিজ্যিক পশুপালন ও মিশ্র কৃষি (Commercial Livestock & Crop Farming)

এ কৃষিব্যবস্থা মিশ্র কৃষি নামে অধিক পরিচিত। ইউরোপীয় দেশ সমূহে এ কৃষি ব্যবস্থা সর্বপ্রথম প্রচলিত হয়। এ কৃষি ব্যবস্থায় গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য রীতিমত চাষাবাদ করা হয়, গবাদিপশু ও উদ্বৃত্ত ফসল বাজারজাত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের কৃষির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়।

১১। জীবিকা নির্বাহী চাষ ও পশুপালন (Subsistance Crop & Livestock Farming)

এ কৃষি ব্যবস্থা উত্তর ইউরোপে উৎপত্তি লাভ করেছে। এটি মোটামুটি ভাবে বাণিজ্যিক পশুপালন ও মিশ্র কৃষি ব্যবস্থার অনুরূপ হলেও উৎপাদিত ফসলের কোন অংশ বিক্রি হয় না। রাশিয়াতে এ কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।

১২। বাণিজ্যিক দুগ্ধ খামার (Commercial Dariy Farming)

মধ্য ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থায় এটি একটি অন্যতম কৃষি পদ্ধতি। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলের দুগ্ধজাত দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে সেখানে, বিশেষ করে শহর এলাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদন ব্যবস্থা প্রসার লাভ করেছে। সাধারণ খামার অপেক্ষা এ খামারে অধিক শ্রমিক নিয়োজিত থাকে এবং সেখানে কোন অবকাশ মৌসুম নেই।

১৩। বিশেষায়িত উদ্যান কৃষি (Specialized Horticulture)

প্রচুর খাদ্য চাহিদা পূর্ণ নগরকেন্দ্র সমূহের কাছে এরূপ কৃষি ব্যবস্থা খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে প্রসার লাভ করেছে। উত্তর আফ্রিকার উপকূলবর্তী এলাকা, ফ্রান্সের ইংলিশ চ্যানেল উপকূলবর্তী ভূভাগ এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এ কৃষি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একে অনেক সময় ট্রাকফার্মিং বলা হয়।

হুইটলেসির তত্ত্বের সুবিধা (Merits of this Theory)

হুইটলেসির পূর্বসূরী অনেক কৃষি বিশেষজ্ঞই জলবায়ুর উপাদানের উপর ভিত্তি করে সমগ্র বিশ্বকে কতিপয় কৃষি অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হুইটলেসি জলবায়ুর সাথে সাংস্কৃতিক উপাদান সংযোজন করে বিশ্বকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করেন যা এ কৃষি ব্যবস্থাকে অনেকটা বাস্তবমুখী করেছে। এতে খুব সহজে বিশ্বের কৃষি অঞ্চল চিহ্নিত করা যায়।

হুইটলেসির তত্ত্বের অসুবিধা ((Demerits of this Theory)

এই তথ্যের কিছু কিছু অসুবিধা লক্ষ্য করা গেছে। যেমন-
  • হুইটলেসি শ্রেণীবিভাগ বর্ণনামূলক,
  • এতে বহু সংখ্যক অকৃষি উপাদানের সংযোজন দেখা যায়,
  • এর শ্রেণীবিভাগ নৈব্যক্তিক না হয়ে রচনামূলক হয়েছে,
  • এখানে খননদন্ড ও লাঙ্গন কৃষির কোন পার্থক্য নিরূপণ করা হয়নি,
  • সমগ্র পৃথিবী থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার বলে প্রতিমান হয়।

হুইটলেসির তত্ত্বের সমালোচনা (Criticism)

হুইটলেসির তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। তার তত্ত্বে অনেক নতুন নতুন তথ্যের সংযোজন দেখা যায়। অনেকে বলেন, তার মতবাদের শ্রেণীবিভাগের বিপুল পরিবর্তন প্রয়োজন কিন্তু এটি দীর্ঘকালীন সময়ের ব্যাপার। আবার অনেকের মতে, তার শ্রেণীবিভাগের অনেক তত্ত্বের এখনো পুরোপুরি ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

উপসংহার

সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে,হুইটলেসি কর্তৃক প্রদত্ত কৃষি অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ বহু সমালোচনার সম্মুখীন হলে্‌ হলেও, এর মতবাদ সব দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আছে। এজন্য তার মতবাদ অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বংশধরদের গবেষণামূলক কৃষি ব্যবস্থার প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকবে।

আজকের এই আর্টিকেলে হুইটলেসি কৃষির শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করা হয়েছে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এ বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। আপনাকে ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যকে জানার সুযোগ করে দিবেন। এতক্ষণ ধরে প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url