সমুদ্রস্রোত কি সমুদ্রস্রোতের কারণ ও সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ

প্রিয় পাঠক,সমুদ্রস্রোত কি সমুদ্রস্রোতের কারণ ও সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নির্ভরযোগ্য ও পছন্দসই তথ্য পাচ্ছেন না? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি প্রয়োজন। মনোযোগের সহিত শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

সমুদ্রস্রোত কি সমুদ্রস্রোতের কারণ ও সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ

আজকের এই প্রতিবেদনে সমুদ্র স্রোত কাকে বলে, সমগ্র স্রোতের কারণসমূহ, সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। চলুন আর দেরি না করে এগুলো বিস্তারিত দেখে নিই।

ভূমিকা

সমুদ্রের পানি স্থির নয়। সমুদ্রে পানি সর্বদাই চলাচল করে। তবে তা মহাসাগরের মধ্যে নির্দিষ্ট এলাকা দিয়ে নিয়মিতভাবে চলাচল করে। এরূপের সমুদ্রের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পানির নিয়মিত চলাচল কে বা প্রবাহকে সমুদ্রস্রোত বলা হয়। মহাসাগর গুলোতে উষ্ণ ও শীতল স্রোতের প্রবাহ লক্ষ করা যায়। আবার প্রধান প্রধান স্রোতগুলো প্রধানত বায়ুর গতিপথ অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলের সূর্যকিরণ লম্বাভাবে পড়ার ফলে ওই অঞ্চলে তাপ বেড়ে যায়, ফলে সেখান থেকে প্রবাহিত স্রোত গুলো উষ্ণ হয়। আর মেরু অঞ্চলের সূর্যকিরণ তীর্যকভাবে পতিত হওয়ার ফলে তাপ খুব কম হয়, বিধায় সেখান থেকে প্রবাহিত স্রোত গুলো শীতল হয়। সমুদ্রের স্রোত পানির উপরিভাগ দিয়ে ও তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানির সমতা রক্ষা করে। সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে প্রবাহিত স্রোত উষ্ণ হয় এবং তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত স্রোত শীতল হয়। উষ্ণ স্রোত হালকা এবং শীতল স্রোত ভারী হয়। সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে মহাসাগর গুলোর পানি পর্যায়ক্রমে সমগ্র পৃথিবী পরিক্রমণ করে থাকে।

সমুদ্রস্রোত কি বা কাকে বলে

সমুদ্রের কোন বিরাট এলাকার ওপর দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত নিয়মিত প্রবাহমান পানির রাশিকে সমুদ্রস্রোত বলে।

আরো সহজভাবে বলা যায় তাপ,চাপ ও ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে পানির উল্লম্ব কিংবা আনুভূমিক সমতা রক্ষার জন্য সমুদ্রের এক স্থান হতে অন্য স্থানে পানির নির্দিষ্ট ও নিয়মিত প্রবাহকে সমুদ্র স্রোত বলে।

অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তির প্রভাবে সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে একটি নির্দিষ্ট দিকে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হয় তখন ওই প্রবাহমান জলরাশির স্থান পরিবর্তন কে  স্রোত বলা হয়।

সমুদ্রস্রোতের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

সমুদ্রের বিশালত্ব এবং স্রোতের উৎপত্তি ও প্রবাহপথ বহু নিয়ামক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে সমুদ্রস্রোত আমাদের নিকট অত্যান্ত জটিল বিষয় হিসেবে পরিগণিত। যার কারণে একে গাণিতিক সূত্রে প্রকাশ করা খুব সহজ নয়। নিম্নের সমুদ্রস্রোতের সাধারণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-
  • সমুদ্রস্রোত বায়ু প্রবাহ এবং আন্তঃপ্রবাহ উভয় হিসেবে প্রবাহিত হতে পারে।
  • সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলের আন্তঃক্রিয়ার ফলে এটি সৃষ্টি হয়।
  • স্রোতের গতিবেগ বায়ু প্রবাহের বৈশিষ্ট্যের দিকের ওপর ও নির্ভর করে।
  • সৌরশক্তিই সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির জন্য প্রধানতঃ দায়ী।
  • সমুদ্রস্রোত উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বেঁকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে প্রবাহিত হয় এবং উভয় ক্ষেত্রে ৪৫ ডিগ্রি অথবা তার অধিক কোন সৃষ্টি করে।
  • স্রোতের গতিবেগ সাধারণতঃ কিলোমিটার / ঘন্টা অথবা ন্যাটিক্যাল মাইল/ঘন্টা হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
  • স্রোত স্থলভাগে প্রতিহত/বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দিক পরিবর্তন করে।

সমুদ্র স্রোতের কারণ (Causes of Ocean Current)

পানির স্বাভাবিক ধর্মই হচ্ছে তার উপরিভাগের সমতা রক্ষা করা। বিভিন্ন কারণে সমুদ্রের উপরিভাগের পানি রাশির সম্যতার ব্যতিক্রম ঘটে। তখন পানির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে সমুদ্রের এক স্থান হতে অন্য স্থানে পানি প্রবাহিত হয় এবং সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়। যে কোন প্রকারেই হোক সৌর বিকিরণের শক্তিই সমুদ্র স্রোত সৃষ্টির প্রত্যাক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে দায়ী। সাধারণত যে সমস্ত কারণে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি বা উৎপত্তি হয় সেগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

১। পৃথিবীর আবর্তনজনিত কারণ (Rotation of the Earth)
(I) মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravitational Force)
(II) করিও লিস শক্তি (Coriolis Force)
২। আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্বন্ধীয় কারণ (Meteorological Effect)
(I) বায়ুর চাপ (Air Pressure)
(II) বায়ুপ্রবাহ (Wind Movement)
(III) বাষ্পীভবন (Evaporation)
৩। সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ (Factors within the Sea water)
(I) গভীরতা জনিত চাপ (Hydrostatic Pressure)
(II) তাপমাত্রার পার্থক্য (Temperature Difference)
(III) লবণাক্ত তারতম্য (Variation of Salinity)
(IV) ঘনত্বের তারতম্য (Variation of Density)
(v) বরফের গলন (Melting of Ice)
৪। অন্যান্য কারণ (Other Causes)
(I) উপকূল রেখার দিক বা ঢাল (Direction & Slope of the Coast line)
(II) ঋতুভিত্তিক তারতম্য (Seasonal Variation)
(III) স্থলভাগের অবস্থান (Presence of Landmass)
(IV) সমুদ্রতলদেশের ভূপ্রকৃতি (Bottom Topography)

১। পৃথিবীর আবর্তনজনিত কারণ (Rotation of the Earth)

পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। আহ্নিক গতির জন্য পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর সর্বদা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। পৃথিবীর এই আবর্তনের ফলে সমুদ্রের অপরিভাগের তরল পানি পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি করেছে। এর কারণেই ফেরলের সূত্র অনুসারে সমুদ্র স্রোত উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। যেমন উত্তর গোলার্ধে উপসাগরীয় স্রোত ও কেনারিস্রোতের প্রবাহ ঘড়ির কাঁটার দিকে অর্থাৎ ডান দিকে ঘুরে থাকে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ গোলার্ধে ব্রাজিল স্রোত পশ্চিমা বায়ু প্রবাহজনিত কারণে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে অর্থাৎ বাম দিকে ঘুরতে থাকে। এটিকে আবার দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

(I) মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravitational Force)

পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ প্রতিটি বস্তুকেই পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করছে। এ আকর্ষণ শক্তি হলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। পৃথিবীর নিরক্ষীয় ব্যাস অপেক্ষা মেরু ব্যাস কম বলে মেরু অঞ্চলের আকর্ষণ শক্তির মান নিরক্ষীয় অঞ্চলের মানের চেয়ে বেশি, এই শক্তির প্রভাবের কারণে সামুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

(II) করিও লিস শক্তি (Coriolis Force)

পৃথিবীর আবর্তনের ফলে অভিকর্ষীয় টানের বিপরীতে পানির কেন্দ্রাতিক বলের উদ্ভব হয়, যা সমুদ্রের পানিকে বাইরে নিক্ষেপ করতে চাই। এই শক্তি সব সময় গতিশীল বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে বলে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে চলমান বস্তুর ওপর এটি কাজ করে। উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যাওয়াতে যে শক্তি প্রভাবিত করে তাকে করিও লিস শক্তি (Coriolis Force) বলে।

২। আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্বন্ধীয় কারণ (Meteorological Effect)

সমুদ্রস্রোতের আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্বন্ধীয় কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করে আলোচনা করা হলো।

(I) বায়ুর চাপ (Air Pressure)

বায়ুমণ্ডলের চাপের উপর ও সমুদ্র স্রোত নির্ভর করে। সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ সমান থাকে না বলে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ বাড়তে থাকলে ওই স্থানের পানিরাশি আয়তন কমে গিয়ে নিচের দিকে নেমে যায় অর্থাৎ পানি রাশির ওপরের অংশ নিচের দিকে এবং নিচের পানির রাশি উপরের দিকে আবর্তন করে। সমুদ্রের ওপর বায়ুমণ্ডলীয় নিম্নচাপ বলয়ে সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে উচ্চচাপ বলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা হ্রাস পায়। ফলে পানির ভারসাম্য রক্ষার্থে সমুদ্রে অন্তঃস্রোত বহিঃস্রোতের সৃষ্টি হয়।

(II) বায়ুপ্রবাহ (Wind Movement)

বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোত উৎপত্তির প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমুদ্রের প্রধান প্রধান স্রোত গুলো প্রধান প্রধান বায়ুপ্রবাহ গুলোর পথ অনুসরণ করে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। আয়নবায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পূর্ব হতে পশ্চিম দিকে এবং প্রত্যয়নবায়ু বা পশ্চিমাবায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। যেমন উত্তর আয়নবায়ু ও দক্ষিণ পূর্ব আয়নবায়ুর প্রবাহের ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যথাক্রমে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের সৃষ্টি হয়। আবার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রত্যয়ন বায়ুর প্রভাবে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপসাগরীয় স্রোত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কুরসীও স্রোত দ্বয় পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়।

(III) বাষ্পীভবন (Evaporation)

বাষ্পীভবন বেশি হলে সমুদ্রের উপরিভাগে পানির উচ্চতা কমে যায়। আবার যে স্থানে বাষ্পীভবন কম, সেখানে পানির উচ্চতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। ফলে পানির সাম্যতা রক্ষার জন্য সমগ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সূর্য তাপের পার্থক্যের কারণে সমুদ্রের বিভিন্ন অংশে বাষ্পীভবনের পার্থক্য হয়ে থাকে।

৩। সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ (Factors within the Sea water)

বিভিন্ন কারণে সমুদ্রের অভ্যন্তরে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়ে থাকে। নিম্নের সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ কারণ সমূহ গুলো উল্লেখ করে বর্ণনা করা হলো।

(I) গভীরতা জনিত চাপ (Hydrostatic Pressure)

সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে গভীরে প্রতি ১০ মিটারে এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বাড়তে থাকে। কারণ এই চাপ পানির গভীরতা ও ঘনত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে চাপ বাড়তে থাকে। ফলে পৃষ্ঠদেশ অপেক্ষা তলদেশের পানির ঘনত্ব বেশি থাকে। আবার গভীরতার পার্থক্যের জন্য উষ্ণতার তারতম্য ঘটে এবং উর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী স্রোতের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পানির গভীরতার তারতম্যের কারণে ঘনত্বের তারতম্য দেখা যায় এবং ঘনত্ব ও চাপ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই দেখা যায় গভীরতা বিভিন্নতার কারণে চাপ, তাপ, লবণাক্ততা ইত্যাদি পার্থক্য হয়ে থাকে এবং সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

(II) তাপমাত্রার পার্থক্য (Temperature Difference)

ক্রান্তীয় ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে উচ্চতা বেড়ে যায় এবং মেরু অঞ্চলের পানি স্বল্প তাপমাত্রার কারণে শীতল ও ভারী হয়ে নিচে নেমে আসে, ফলে ক্রান্তীয় ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের পানি সাম্যতা রক্ষার জন্য পৃষ্ঠস্থ স্রোত মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় এবং মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী পানি আন্তঃপ্রবাহ হিসেবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এভাবে একটি স্রোতচক্রের করে।

(III) লবণাক্ত তারতম্য (Variation of Salinity)

বৃষ্টিপাত, বাষ্পীভবন, নদ-নদী, বরফগলা পানি প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে সমুদ্রে সর্বত্র লবণাক্ততার পরিমাণ সমান থাকে না। অধিক লবণাক্ত পানি কম লবণাক্ত পানি অপেক্ষা ঘন ও ভারী বলে পানির চাপও বেশি থাকে। ফলে অধিক লবণাক্ত পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হয় এবং হালকা ও অপেক্ষা কিন্তু কম লবণাক্ত পানি উপরের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপে উর্ধ্ব ও নিম্ন স্রোতের অর্থাৎ পরিচালন স্রোতের সৃষ্টি হয়।

(IV) ঘনত্বের তারতম্য (Variation of Density)

তাপমাত্রা, চাপ ও লবণাক্ততা প্রভৃতির তারতম্যের কারণে পানির ঘনত্বের তারতম্য ঘটে। ঘনত্বের তারতম্যের কারণ সমুদ্রের পানিতে উলম্ব ও আনুভূমিক স্রোতের সৃষ্টি হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে আনুভূমিক স্রোত এবং মেরু অঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে আন্তঃস্রোত হিসেবে প্রবাহিত হয়।

(v) বরফের গলন (Melting of Ice)

বরফ গলনের ফলে সাধু পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে পানির ঘনত্ব, লবণাক্ততা ও চাপ হ্রাস পায়। যার ফলে ওই পানি ওই অঞ্চল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে স্রোতের সৃষ্টি করে। যেমন গ্রিনল্যান্ড স্রোত এরূপে সৃষ্টি হয়েছে।

৪। অন্যান্য কারণ (Other Causes)

উপরোক্ত কারণ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে সমুদ্রস্রোত হতে পারে এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

(I) উপকূল রেখার দিক বা ঢাল (Direction & Slope of the Coast line)

উপকূলের গঠন ও আকৃতি সমুদ্র স্রোতের পরিবর্তনে এবং নতুন স্রোত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন উপকূল ভাগ কঠিন শিলায় গঠিত হলে, উক্ত শিলায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্রোত সহজেই পরিবর্তিত কিংবা দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে এবং নতুন স্রোতের সৃষ্টি হতে পারে।

(II) ঋতুভিত্তিক তারতম্য (Seasonal Variation)

ঋতু পরিবর্তনের সাথে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের পরিবর্তন হয়। ফলে সমুদ্রের পানির ভৌত ও রাসায়নিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের সৃষ্টি হয়। ফলে সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি ও পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেমন মৌসুমী বায়ুর দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় স্রোতের দিক ও পরিবর্তিত হয়।

(III) স্থলভাগের অবস্থান (Presence of Landmass)

সমুদ্রস্রোতের সম্মুখে স্থলভাগের অবস্থান থাকলে স্রোতের দিক পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্রোতের উৎপত্তি হয়। যেমন আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত ব্রাজিলের উপকূলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে।

(IV) সমুদ্রতলদেশের ভূপ্রকৃতি (Bottom Topography)

সামুদ্রতল দেশের ভূপ্রকৃতিতে সামুদস্রোত ধাক্কা খেয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। যেমন- শৈলশিরায় ধাক্কা খেয়ে আটলান্টিক মহাসাগরীয় শীতল প্রবাহ ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া শৈলশিরা উভয় পাশে লবণাক্ততা ঘনত্ব উষ্ণতা ও চাপের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় যেগুলো প্রভাবে সমুদ্র স্রোত ও প্রভাবিত হয়।

সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ

সমুদ্রস্রোতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মহাসাগর গুলোর স্রোতগুলোকে ৫ টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে যথা-

১। উষ্ণ স্রোত
২। শীতল স্রোত
৩। পৃষ্ঠ স্রোত
৪। অন্তঃস্রোত এবং
৫। পরিচলন স্রোত

১। উষ্ণ স্রোত

উষ্ণ অঞ্চল থেকে প্রবাহিত স্রোত গুলো উষ্ণ স্রোত হিসেবে পরিচিত। নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে সর্বাধিক সূর্যের কিরণ পতিত হয় বলে সেখানকার পানিরাশি অধিক উত্তপ্ত হয়। কাজেই এই উত্তপ্ত এলাকাসমূহ হতে প্রবাহিত স্রোত গুলোর পানির স্বভাবতই উষ্ণ থাকে। আর এ কারণে এদেরকে উষ্ণ স্রোত বলে। যেমন উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থিত উপসাগরীয় স্রোত উষ্ণ স্রোত।

২। শীতল স্রোত

মেরু অঞ্চল হতে প্রবাহিত স্রোতগুলোকে শীতল স্রোত বলে। মেরু অঞ্চলের সূর্যকিরণ অধিক তির্যকভাবে পতিত হয় বলে শৈতের প্রভাব বেশি। এছাড়া মেরু অঞ্চলদ্বয় সারা বছরই বরফে ঢেকে থাকে। আর এ কারণে মেরুঅঞ্চল হতে প্রবাহিত স্রোতগুলো শীতল হয়। যেমন-প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত কামচাটকা স্রোত শীতল স্রোত।

৩। পৃষ্ঠ স্রোত

সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি হালকা হওয়ায় তা সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে উষ্ণঅঞ্চল হতে শীতল অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ প্রবাহমান স্রোতকে পৃষ্ঠস্রোত বলে। যেমন- দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত পৃষ্ঠস্রোত।

৪। অন্তঃস্রোত

শীতল পানি ভারী হওয়ায় তা সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে পৃষ্ঠ স্রোতের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়, যা অন্তঃস্রোত নামে পরিচিত। আরএ স্রোত সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে শীতল অঞ্চল হতে উষ্ণ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। যেমন-লাব্রাডার স্রোত এর উদাহরণ।

৫। পরিচলন স্রোত

উষ্ণ স্রোত মেরু অঞ্চলের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় ক্রমশ শীতল হয়ে ভারী হয়। এক সময়ে এ স্রোত সমুদ্রের তলদেশে নিমজ্জিত হয় আবার শীতল অঞ্চল হয়ে শীতল বা নিমজ্জিত স্রোত অন্তঃস্রোত রূপে উষ্ণ অঞ্চলে ধাপিত হলে তা উষ্ণ পানির সংস্পর্শে উষ্ণ ও হালকা উপরের দিকে উঠে আসে। এরূপ পর্যায়ক্রমিক আবর্তনকে পানির পরিচালন স্রোত বলে।

উপসংহার

আজকের এই প্রতিবেদনে সমুদ্রস্রোত কি বা সমুদ্রস্রোত কাকে বলে, সমুদ্রস্রোতের বিভিন্ন কারণ সমূহ গুলো সহ সমুদ্রস্রোতের শ্রেণীবিভাগ গুলি বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করছি এই বিষয় সম্পর্কে সঠিক এবং পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। এ প্রতিবেদন সম্পর্কে যদি কোন মতামত থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এতক্ষণ ধরে ধৈর্যের সহিত এই প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url