প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তলদেশের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা
প্রিয় পাঠক, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তলদেশের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য জানার জন্য খুব আগ্রহী, কোথায় সঠিক তথ্য পাবেন এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত, কোন লেখকের বই অনুসরণ করবেন এই নিয়ে উদ্বিগ্ন? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তলদেশের ভূপ্রকৃতি যেমন-মহীসোপান, মালভূমি, শৈলশিরা, উপত্যকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় গিরিখাত, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপসমূহ, প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তদেশীয় সাগরসমূহ সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। চলুন বিস্তারিত দেখে নিই।
ভূমিকা
প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাসাগর এবং সমগ্র মহাসাগর গুলোর প্রায় অর্ধেক আয়তন জুড়ে রয়েছে। এর পূর্বে আমেরিকা মহাদেশ ও পশ্চিমে এশিয়া মহাদেশ এবং উত্তরে বেরিং প্রণালী ও দক্ষিণে এন্টারটিকা মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর দক্ষিণে এটি প্রায় ১৪৪৯০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে নিরক্ষরেখার নিকট দীর্ঘতম বিস্তার প্রায় ১৬১০০ কিঃ মিঃ। এ মহাসাগরের আয়তন প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এবং গড় গভীরতা ৩৯০০ মিটার। এর আকৃতি একটি বৃহদাকার ত্রিভুজের ন্যায় যার শীর্ষবিন্দু উত্তরে ব্রেনিং প্রণালী বেরিং প্রণালীর নিকট অবস্থিত।
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের ভূপ্রকৃতি
সমুদ্র গবেষক জনস্টোনের মতানুসারে মহাসাগরের তলদেশের বৈশিষ্ট্যনুযায়ী প্রশান্ত মহাসাগরকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল- এর গড় গভীরতা ৫০০০ থেকে ৬ ০০০ মিটার। বেশিরভাগ প্রান্ত সীমা হল দ্বীপ।
২। মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল- এ অংশে বেশিরভাগ দ্বীপ দেখা যায়। এখানকার গড় গভীরতা প্রায় ২০০০ মিটার।
৩। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর- এ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের দ্বীপ রয়েছে। এখানকার গড় গভীরতা প্রায় ৪০০০ মিটার।
৪। দক্ষিণ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর- এই অংশের সমুদ্রের উচ্চ শৈলশিরা ও মালভূমি রয়েছে। এখানকার গড় উচ্চতা প্রায় ৪০০০ মিটার।
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের ভূমিরূপ গুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
১।মহীসোপান
প্রশান্ত মহাসাগরের যে বিস্তীর্ণ মহীসোপান দেখা যায় তা অস্ট্রেলিয়া, ইস্ট ইন্ডিজ এবং এশিয়া মহাদেশের পূর্ব উপকূলে রয়েছে। এ অংশে অনেক দীপ আছে। এখানকার গভীরতা প্রায় গড়ে ১০০০ মিটার।এখানে প্রায় ১৫০ থেকে ১৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত মহীসোপান রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও এন্টারটিকা এক অগভীর মহীসোপান অঞ্চল দ্বারা যুক্ত। কেবলমাত্র আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে মহীসোপানের প্রশস্ততা মাত্র ৭৮ কিলোমিটার। এই মহাসাগরের উত্তরাংশে অবস্থিত মহাদেশ গুলোর মহীসোপান অঞ্চল খুবই কম এবং স্থানে স্থানে মহাদেশ গুলো খাড়া ভাবে সোজা গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করেছে।
২। মালভূমি
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে আন্তঃমহাসাগরীয় মালভূমির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। মালভূমির মধ্যে বিখ্যাত ও সর্ববৃহৎ মালভূমি হল দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত অ্যালবার্টস অ্যালবেট্রস মালভূমি। এটি প্রশান্তমহাসাগরের প্রান্তে ক্যালিফোর্নিয়া উপদ্বীপের দক্ষিণপ্রান্ত হতে দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় গভীরতা ৪০০০ মিটার। এ ছাড়া চিলির পশ্চিম দিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত আরো একটি মালভূমি রয়েছে যা দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় মালভূমি নামে পরিচিত। নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণে ও একটি মালভূমি রয়েছে যা নিউজিল্যান্ড মালভূমি নামের খ্যাত।
৩। শৈলশিরা
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে সুউচ্চ পর্বত মালার মতো ভূপ্রকৃতি রয়েছে। এ মহাসাগরের উল্লেখযোগ্য শৈলশিরা হলো-প্যাসিফিক এন্টারটিকা শৈলশিরা যা এই মহাসাগরের দক্ষিণ সীমা ও এন্টারটিকা মহা- দেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এছাড়া হাওয়াই দ্বীপের দক্ষিণে হাওয়ায় উচ্চভূমি, ম্যারিয়ানা খাতের পূর্বে মার্কাস নেকার শৈলশিরা, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় শৈলশিরা, নিউজিল্যান্ডের পূর্ব দিকে চেটাম শৈলশিরা, নিউজিল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে লর্ডহাউ শৈলশিরা, চিলির উপকূলে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত স্যান ফার্নান্ডেজ শৈলশিরা, উত্তরে প্রশান্ত কুমেরু শৈলশিরা প্রভৃতি রয়েছে।
৪। প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপত্যকা
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে বেশ অনেকগুলো উপত্যকা রয়েছে। এগুলো দুইটি শৈলশিরার মাঝখানে বা উচ্চস্থানের মাঝখানে যে নিম্নঅঞ্চল রয়েছে সে সকল উপত্যকার কতিপয় বিবরণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
(I) অ্যালুসিয়ান উপত্যকা
এটি অ্যালুসিয়ান দ্বীপের উত্তরে অবস্থিত যার গভীরতা প্রায় ৪ হাজার মিটার।
(II) পশ্চিম কেরোলাইন উপত্যকা
ফিলিপাইনের পূর্বে অবস্থিত একটি গোলাকার উপত্যকা। এর গভীরতা প্রায় ৪০০০ থেকে ৫ হাজার মিটার।
(III) পূর্ব কেরোলিন উপত্যকা
এলাকাটি ইউরোপিক ও উত্তর গিনি দ্বারা পশ্চিম দিক থেকে পৃথক হয়ে রয়েছে। এখানকার গড় গভীরতা প্রায় ৫০০০ মিটার।
(IV) ফিজি উপত্যকা
ফিজি দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত এটি ১০ ডিগ্রি উত্তর থেকে ৩২ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানকার গড় গভীরতা প্রায় ৪ হাজার মিটার।
(V) পূর্ব অস্ট্রেলিয়ান উপত্যকা
এটি অস্ট্রেলিয়ার পূর্বভাগে অবস্থিত এর গড় গভীরতা প্রায় চার হাজার মিটার। আবার উত্তর অক্ষাংশের গভীরতা প্রায় পাঁচ হাজার মিটারের অধিক। এই স্থানটির পূর্বেরসীমা রেখায় লর্ড হই (Lord Howe) অবস্থিত।
(VI) দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উপত্যকা
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে এটি অবস্থিত। এটি দেখতে লম্বা আকৃতি এর গড় গভীরতা প্রায় ৫০০০ মিটার।
(VII) দক্ষিণ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপত্যকা
এই উপত্যকাটির গড় গভীরতা প্রায় ৫০০০ মিটার। এর বিস্তৃতি পেরুর পশ্চিম থেকে চিলি পর্যন্ত এর মধ্যে বেনার উপত্যকা ৫২৬৬ মিটার।
(VIII) প্রশান্ত ও দক্ষিনে এন্টার্কটিকা উপত্যকা
এটি চিলির দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর গড় গভীরতা প্রায় ৪০০০ থেকে ৫ হাজার মিটার।
৫। প্রশান্তমহাসাগরীয় গভীর খাত গিরিখাত
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের গভীরতা জরিপের সময় অনেকগুলো গভীর খাতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর উৎপত্তির পেছনে রয়েছে দুইটি প্লেটের কেন্দ্রাভিমুখী গতি, যার কারণে প্লেট সীমান্তে একটি প্লেট নিমজ্জিত হয়ে যায়।
(I) অ্যালুসিয়ান খাত
এটি অ্যালুসিয়ান দ্বীপের নিম্নভাগে অবস্থিত। এ খাতের দৈর্ঘ্য ৩৭০০ কিলোমিটার। গড় প্রশস্ততা ৫০ কিলোমিটার এবং গভীরতা ৭৭০০ মিটার।
(II) কুড়িল কামচাটকা খাত
জাপান দ্বীপের অন্তরালে এ খাত দুটি অবস্থিত। এ খাত ২৮ থেকে ৫০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে ২৬০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং স্থলভাগ থেকে ১৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ খাতের গড় গভীরতা প্রায় ১০৩৭৭মিটার।
(II) ফিলিপাইন খাত
৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাতটি ফিলিপাইন দ্বীপের পূর্ব উপকূল বরাবর অবস্থিত। এখানে মিনডানায়ো দ্বীপের কাছে সবচেয়ে গভীর খাত দেখা যায়। এর গভীরতা ১০.৫ কিলোমিটার
(III) নিরো খাত
এ খাতটি ম্যারিয়ানা দ্বীপ বরাবর বিস্তৃত। এটি ম্যারিয়ানা খাত নামে পরিচিত এবং এর গভীরতা সর্বাধিক ১১ কিলোমিটার।
(IV) পেরু-চিলি খাত
এক খাতটি বিচ্ছিন্নভাবে আনদিয়ান উপকূল বরাবর বিস্তৃত। এখানকার বৃহৎ খাত বাথোলোমিউ নামে পরিচিত। পেরু চিলি খাতটি প্রায় ৮১০০ মিটার গভীর।
এ সকল গুরুত্বপূর্ণ খাত গুলো ছাড়াও আরো কতগুলো খাত দেখা যায়। সেগুলোর মধ্যে রাওকু খাত ৬০০০ মিটার, ব্রকি খাত ৬০০০ মিটার, বাইলে খাত ৬০০০ মিটার, প্লানেট খাত ৭০০০ মিটার, মধ্যে আমেরিকান খাত ৬৭০০ মিটার, বেনিন খাত ৯৮০০ মিটার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৬। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ
প্রশান্ত মহাসাগরে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। বৃহদাকার দ্বীপগুলো অধিকাংশই মহাদেশের নিমজ্জিত বিচ্ছিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত। প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বপ্রান্তে অ্যালুসিয়ান দ্বীপ ও চিলির দ্বীপপুঞ্জ মহাদেশের বিচ্ছিন্ন অংশ হতেই উদ্ভূত। পশ্চিম প্রান্তে ও এরূপ বহু দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ, জাপান দ্বীপপুঞ্জ, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং নিউজিল্যান্ড দ্বীপ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহাদেশের নিমজ্জিত অংশ নিয়ে গঠিত দ্বীপপুঞ্জ ছাড়াও আগ্নেয়গিরি ও প্রবাল কীট দ্বারা গঠিত বহু দ্বীপপুঞ্জ প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে।
৭। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তদেশীয় সাগর সমূহ
প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্ত ভাগে প্রধান পানিরাশি থেকে বিচ্ছিন্ন কতগুলো সাগর রয়েছে। এই বিচ্ছিন্ন সাগর গুলো মহাসাগরের পশ্চিমে এশিয়া মহাদেশ ও তৎসংলগ্ন দ্বীপমালার মধ্যবর্তী অঞ্চলেই অধিক দেখতে পাওয়া যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন সাগরের মধ্যে বেরিং সাগর, জাপান সাগর, পীতসাগর, পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
ভূপ্রকৃতি ও গঠনের দিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্যান্য মহাসাগর গুলো থেকে পার্থক্য রয়েছে। এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিরূপ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে গভীর গিরিখাত। এ সকল গিরিখাত গুলো ভূমিকম্পের দিক থেকে খুবই সক্রিয় এবং বহু ভূমিকম্প ও আগ্নেয় অগ্নুৎপাত এখানে সংঘটিত হয়ে থাকে।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url