আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা

প্রিয় পাঠক, আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য জানতে আগ্রহী, এ বিষয়ে জানার জন্য কোথায় নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবেন এই নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আজকের এই প্রতিবেদনটি আপনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

আটলান্টিক মহাসাগরের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা

আজকের এই প্রতিবেদনে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের বিভিন্ন রকমের ভূমিরূপ, মহীসোপান, মহীঢাল, মালভূমি, শৈলশিরা, ব-দ্বী প সমূহ, উপত্যকা সমূহ, বিভিন্ন সাগর, উপসাগর সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মনোযোগের সহিত শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

ভূমিকা

আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন প্রায় ১০৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। এ আয়তনের মধ্যে আর্কটিক সাগর যুক্ত রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগর তুলনামূলকভাবে কম প্রশস্ত এবং উত্তর থেকে দক্ষিনে 'S' অক্ষরের মতো বিস্তৃত। আর্কটিক সাগরসহ এটি সবচেয়ে লম্বা সাগর যা উত্তর দক্ষিনে মেরু অঞ্চল গুলোকে যুক্ত করেছে। এ মহাসাগরের পূর্ব দিকে ইউরোপ ও আফ্রিকা এবং পশ্চিমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশদ্বয় অবস্থিত। আটলান্টিক মহাসাগর নিরক্ষরেখার নিকট সর্বাপেক্ষা সংকীর্ণ এবং এ অংশে এটি ২৫৭৬ কিলোমিটার প্রশস্ত। কিন্তু নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর ও দক্ষিণে এটি ক্রমশ চওড়া হয়ে গিয়েছে। সবগুলো মহাসাগরের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের মহীসোপান সবচেয়ে প্রশস্ত।

আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের ভূপ্রকৃতি

আটলান্টিক মহাসাগর এর তলদেশের বিভিন্ন রকমের ভূমিরূপ বা ভূপ্রকৃতি নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে উল্লেখ করা হলো-
১। মহীসোপান
২। আটলান্টিক শৈলশিরা (Atlantic Ridge)
৩। মালভূমি
৪। আটলান্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপ সমূহ
৫। আটলান্টিক মহাসাগরের উপত্যকা সমূহ (Basins of the Atlantic Ocean)
৬। গভীর খাত বা গিরিখাত (Trenches)
৭। আটলান্টিক মহাসাগরের প্রান্তদেশীয় সাগর সমূহ

১। মহীসোপান

উপকূল রেখা থেকে ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত অগভীর অঞ্চলকে মহীসোপান বলে। স্থলভাগ সংলগ্ন বহু অগভীর সাগর যেমন ক্যারিবিয়ান, ভূমধ্যসাগর, বালটিক, মেক্সিকো উপসাগর, আর্কটিক সাগর সমূহের প্রশস্ত মহীসোপান থাকার দরুন এ সাগর সবচেয়ে কম গভীরতা সম্পন্ন। এ মহাসাগরের গড় গভীরতা ৩৩১০ মিটার। উপকূল ভাগে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গভীরতার প্রেক্ষিতে মহীসোপানের বিস্তৃতি কোথাও ৭৮ কিলোমিটার আবার কোথাও ১ থেকে ৩ কিলোমিটার। এই বিস্তৃতি উপকূল ভাগের ভূমিরূপ এর উপর নির্ভর করে।


যে সকল উপকূল পর্বত বেষ্টিত সে সকল স্থানে মহীসোপান খুব ঢালু এবং কম প্রশস্থ, যেমন ব্রাজিল উপকূলে মহীসোপানের প্রশস্ততা কম। আবার ইউরোপ উপকূলভাগে এর প্রশস্ততা ৭৬ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং লাব্রাডর প্রণালীতে এর বিস্তৃতি প্রায় ১৫০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। ফ্লোরিডা ও নিউফাউন্ডল্যান্ডের মাঝখানের প্রশস্ততা প্রায় ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। উত্তরে কেপ হাটারাশের কাছে বিস্তৃত প্রায় ২০০ কিলোমিটার। নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের কাছে পৃথিবীর বৃহত্তম মহীসোপান গ্র্যান্ড ব্যাংক ও ডগার ব্যাংক অবস্থিত। গ্রিনল্যান্ডের কাছেও বেশ বড় মহীসোপান রয়েছে।

২। আটলান্টিক শৈলশিরা (Atlantic Ridge)

আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের ভূমিরূপ এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বৈচিত্র্য হলো এর তলদেশের ঠিক মাঝামাঝি অংশ দিয়ে উত্তর দক্ষিণের বিস্তৃত ইংরেজি 'S' অক্ষরের মতো এক বিশাল উচ্চভূমি যা মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা নামে পরিচিত। এটি একটি পানি মগ্ন শৈলশিরা। এটি প্রায় ২০,০০০ কিঃমিঃ দীর্ঘ ও সমুদ্রতলদেশ থেকে ১০০০ থেকে ২০০০ মিটার উচ্চে অবস্থিত। এটি উত্তরে আইসল্যান্ড থেকে দক্ষিনে এন্টারটিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। 

বিজ্ঞানীদের মতে অতীতে এ প্লেট সীমানা বরাবর আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যস্থলে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত সুদীর্ঘ ফাটল ছিল। সেই স্থান থেকে অভ্যন্তরীণ পদার্থ সমূহ ওপরে উন্নীত ও সঞ্চিত হয়ে উচ্চভূমি তথা মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর আটলান্টিকে অবস্থিত অংশকে ডলফিন শৈলশিরা এবং দক্ষিণ আটলান্টিক এ অবস্থিত অংশকে চ্যালেঞ্জার শৈলশিরা বলে। এ শৈলশিরার গড় গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৩০৫০ মিটার।

এই শৈলশিরা ছাড়াও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমে টেলিগ্রাফ মালভূমির পূর্বে ফ্যারো-আইসল্যান্ড শৈলশিরা, গ্রীনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের মধ্যবর্তী অংশের নাম গ্রিনল্যান্ড শৈলশিরা, গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম পাশ দিয়ে বেফিন উপসাগরের দিকে বিস্তৃত উচ্চভূমিকে বেফিন গ্রীনল্যান্ড শৈলশিরা, চ্যালেঞ্জার শৈলশিরার দক্ষিনে তৃস্তান- দা- কুনহা দ্বীপের নিকট হতে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে প্রসারিত ওয়ালভিস শৈলশিরা এবং এর পশ্চিমে রিওগ্রান্ড শৈলশিরা অবস্থিত।

৩। মালভূমি

আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে কিছু সংখ্যক মালভূমি রয়েছে যা শৈলশিরার সাথে সম্পর্কযুক্ত। মালভূমির মধ্যে টেলিগ্রাফ মালভূমি প্রসিদ্ধ। এটি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম সীমা হতে গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিশাল মালভূমি এত উঁচু যে এর উপরিভাগের গড় গভীরতা প্রায় ৯০০ মিটার হতে ১০৭০ মিটার। টেলিগ্রাফের প্রথম সাবমেরিন কেবল এর ওপর স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ দ্বীপ পুঞ্জের পশ্চিম দিকে এ মালভূমির পূর্বাংশ 'উইভিল টমসন' মালভূমি নামে পরিচিত। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশেও কয়েকটি আড়াআড়ি মালভূমি রয়েছে যা শৈলশিরা সাথে পরস্পর সংযুক্ত।

৪। আটলান্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপ সমূহ

শৈলশিরা যদিও সাধারণত সমুদ্রের পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে তবুও অনেক স্থানে শিখরগুলো পানি পৃষ্ঠ থেকে উৎখিত হয়ে উঁচু হয়ে থাকে। এই উঁচু পর্বতগুলো সবই প্রায় মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত।

আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপের সংখ্যা খুব কম তবে দ্বীপগুলো অধিকাংশ উত্তর আটলান্টিক অবস্থিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তর আটলান্টিকের পূর্ব উপকূলে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও পশ্চিম উপকূলে নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপ। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উত্তরসীমা ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত অংশে কতিপয় দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এদের মধ্যে আইসল্যান্ড দ্বীপ প্রধান। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মূল ভূখণ্ডের খুব কাছাকাছি অবস্থিত হলো এটি মহিসোপানের ওপর অবস্থিত। এ ছাড়া কেনারি দ্বীপপুঞ্জ ফকল্যান্ড জর্জিয়া স্যান্ডউইচ প্রভৃতি দ্বীপগুলো সমুদ্রে নিমগ্ন উচ্চ মালভূমি ও শৈলশিরা দ্বারা গঠিত।

৫। আটলান্টিক মহাসাগরের উপত্যকা সমূহ (Basins of the Atlantic Ocean)

মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে ছোট বড় বেশ কিছু অবনমিত অঞ্চল বা উপত্যকার সৃষ্টি করেছে। এই মহাসাগরের উল্লেখযোগ্য উপত্যকা গুলো হল-লাব্রাডার উপত্যকা, উত্তর-পূর্ব আটলান্টিক উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম আটলান্টিক উপত্যকা,কেপ ভারডি উপত্যকা, ব্রাজিলিয়ান উপত্যকা, দক্ষিণ-পূর্ব আটলান্টিক উপত্যকা, কেপ উপত্যকা, আর্জেন্টিনা উপত্যকা, আগুলহাস উপত্যকা, আটলান্টিক ভারত দক্ষিণ মেরু পতাকা ইত্যাদি।

৬। গভীর খাত বা গিরিখাত (Trenches)

আটলান্টিক মহাসাগরের খাতের সংখ্যাও খুব কম। আবার খাতগুলো গভীরতা ও তুলনামূলকভাবে কম। এখানে যে সকল গভীর খাত রয়েছে তার মধ্যে ১৯ টির গভীরতা.৫৪৮৬ মিটারের অধিক। পোর্টোরিকো খাত এ মহাসাগরের গভীরতম খাত, এর গভীরতা ৮৫৩৮ মিটার। এটি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে পোরটোরিকো দ্বীপের নিকট অবস্থিত। দক্ষিণ স্যান্ডউইচ খাত ৮৪০০ মিটার দ্বিতীয় বৃহত্তম গভীরতম খাত। এটি দক্ষিণ আটলান্টিকের দক্ষিণ অংশের হর্ন অন্তরিপের দক্ষিণে স্যান্ডউইচ দ্বীপের নিকট অবস্থিত। এছাড়া রয়েছে রোমান্সে খাত যা আটলান্টিকের মধ্যভাগে নিরক্ষরেখা বরাবর ২০ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমারেখার নিকট অবস্থিত যার গভীরতা ৭৫৯৪ মিটার।

৭। আটলান্টিক মহাসাগরের প্রান্তদেশীয় সাগর সমূহ

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের প্রধান সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন সাগর বা উপসাগরের সংখ্যা কম। কিন্তু উত্তর আটলান্টিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের তীরবর্তী অঞ্চলে এগুলোর সংখ্যা অধিক। ইউরোপ মহাদেশের বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত বলে এ অঞ্চলে বহু সাগর ও উপসাগরের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উত্তরসাগর, বালটিক সাগর, বিস্কে উপসাগর, এজিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর, মার মারা সাগর উল্লেখযোগ্য। অপারপাশে উত্তর আমেরিকা মহাদেশে হাডসন উপসাগর,বেফিন উপসাগর, মেক্সিকো উপসাগর, ক্যারিবিয়ান উপসাগর প্রভৃতি অবস্থিত।

উপসংহার

আটলান্টিক মহাসাগর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। এটি পৃথিবীর মহাসাগর গুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমীক্ষিত মহাসাগর। পূর্বে সমীক্ষাগুলো থেকে লক্ষ্য করা যায় যে মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরাই এখানকার ভূপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রণকারী মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০,০০০ কিলোমিটার। এ শৈলশিরার উপরিভাগ অসমতল, বহু সংখ্যক ফাটল, পাহাড় ও শৃঙ্গ রয়েছে। এটি ভূকম্পন তরঙ্গের দিক থেকে অত্যন্ত সক্রিয় এবং শৈলশিরার কেন্দ্রের অভ্যন্তর থেকে অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এগুলার উপর বর্তমানের নানা ধরনের সমীক্ষা চলছে এবং আগামীতে পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে অনেক তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url