পানামা খালপথ কি পানামা খালের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমূহ
প্রিয় পাঠক,পানামা খালপথ কি পানামা খালের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমূহ সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য জানতে চান, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানার জন্য কোথায় অনুসন্ধান করবেন এই নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। কারণ এই প্রতিবেদনটি আপনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে পানামা খালপথ কি এ খালের বৈশিষ্ট্য সমূহ, এর গুরুত্ব, প্রধান প্রধান বন্দর সমূহ, এর সুবিধা ও অসুবিধা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাণিজ্য সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। চলুন এবার বিস্তারিত দেখে নিই।
ভূমিকা
আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে দূরত্ব হ্রাস করে দুটি মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য কৃত্রিম উপায়ে মানুষদের নৌপথ খনন করে তাকে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক খালপথ বলে। যে সমস্ত উদ্দেশ্যে সামুদ্রিক খাল খনন করা হয় তা হল-আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক পথের দূরত্ব হ্রাস করার জন্য, দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামুদ্রিক বন্দর গড়ে তোলার জন্য, দেশের বিভিন্ন শহর ও বন্দরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য, নদী বা সমুদ্রপথের তীব্র বা বিরূপ স্রোতকে পরিহার করার জন্য, পরিবহন ব্যয় হ্রাসের জন্য ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র খাল দুইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল-
১। সুয়েজ খাল পথ (Suez Canal Route) এবং
২। পানামা খালপথ (Panama Canal Route)।
পানামা খালপথ (Panama Canal Route)
উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা নৌপথে যাতায়াতের জন্য যে খাল খনন করা হয় তাই পানামা খাল নামের পরিচিতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পথ হিসাবে পানামা খাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার সাথে পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়ার বাণিজ্য বিস্তারে এ পথের ভূমিকা অনন্য।
পানামা খাল প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে ক্যারিবিয়ান উপসাগর তথা আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগ স্থাপন করেছে। ১৯০৪ সালে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী যোজক পানামাকে কেটে এর খনন কাজ শুরু হয়। এটি সমাপ্ত করতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে এ খালপথ কাটার ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পানামা খালের বৈশিষ্ট্য (Characteristics)
যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পানামা খাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলো হল-
- পানামা খালের গড় গভীরতা ১৫ মিটার।
- পানামা খালের দৈর্ঘ্য ৯২ কিলোমিটার।
- এক খালটিতে দুইটি হ্রদ বিদ্যামান। একটি মিরাফ্লোর্স এবং অন্যটি গাটুন হ্রদ।
- পানামা খালে দুইটি জাহাজ অনায়াসে একসঙ্গে চলাচল করতে পারে।
- প্রতিদিন প্রায় ৫০/৬০ টি জাহাজ এ খাল পথ দিয়ে চলাচল করে।
- প্রতি বছরে পানামা খাল দিয়ে প্রায় ৬ হাজার জাহাজ চলাচল করে থাকে।
- পানামা খালটিতে চলাচলকারী জাহাজগুলোর অর্ধেক এরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
- প্রতিটি জাহাজ খালটি অতিক্রম করতে প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় লাগে।
পানামা খালের গুরুত্ব (Importance)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়ার দেশগুলোর বহির্বাণিজ্যে পানামা খাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ খাল খননের ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলকে উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের নিকটবর্তী করেছে।
এ খাল খননের পূর্বে উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় বন্দরগুলোতে চলাচল করতো। কিন্তু বর্তমানে পানামা খাল খননের ফলে এর দূরত্ব অনেক হ্রাস পেয়েছে। এ পথ উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক বন্দরগুলোর সাথে এশিয়া ওশেনিয়ার বন্দরগুলোর দূরত্ব অনেক কমিয়ে দিয়েছে, যা অধিক যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সাহায্য করছে।
পরিবাহিত পণ্যদ্রব্য সমূহ (Transp0rted Commodities)
এ সমুদ্রপথে পশ্চিম ইউরোপের সাথে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, ওশেনিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য হয়। আবার ওশেনিয়া ও এশিয়ার সাথে উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলের বাণিজ্য ও এ পথ দিয়ে সংঘটিত হয়। এ পথে পরিবাহিত পণ্যগুলো হল-লৌহ. আকরিক. কলকবজা. যন্ত্রপাতি, কাগজ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ এবং গম, কফি, কোকো, চা, তামাক, তেলবীজ, তুলা, কাট কাট হরি কাঠ, কাঠমুন্ডু, গবাদিপশু ইত্যাদি।
পানামা খালের প্রধান বন্দর সমূহ
পানামা সমুদ্র পথের প্রধান বন্দর গুলো হল, উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক, চার্লস্টোন, নিউঅলিন্স, ভ্যাঙ্কবার,সানফ্রান্সিসকো,এঞ্জেলস। দক্ষিণ আমেরিকার কারাকাস, জর্জটাউন, রিওডিজেনিরো। ওসেনিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন এবং এশিয়ার টোকিও, ওসাকা, সাংহাই ইত্যাদি।
পানামা খালের সুবিধা সমূহ
পানামা খাল থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো হল-
- কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উভয় উপকূলের দূরত্ব কমে গেছে, ফলে বাণিজ্যে প্রসার ঘটেছে।
- পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে।
- পানামা খালের জন্য অপেক্ষাকৃত কম শুল্ক দিতে হয়।
- পানামা খাল পথে যুদ্ধজাহাজ সমূহ আটলান্টিক মহাসাগর হতে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্রুত যাতায়াত করতে পারে।
- পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
পানামা খাল পথের অসুবিধা সমূহ
এ পথের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকলেও কিছু কিছু অসুবিধা লক্ষ্য করা গেছে যেমন-
- লকগেটের সাহায্যে পানি নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই জাহাজ ধীরগতিতে চলে।
- খালের ২ তীরে জনসংখ্যা ও পোতাশ্রয় এর সংখ্যা কম।
- বিধংসী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন এর উৎপত্তিস্থল ক্যারিবিয়ান সাগর, তাই বিপদের ঝুঁকি থাকে।
- খালটি অতিক্রম করতে দীর্ঘ সময় লাগে।
পানামা খাল কাটার পর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য পথগুলো অত্যন্ত কর্ম চঞ্চল হয়ে ওঠে। এটি উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলকে আটলান্টিক উপকূলের কাছে এনে দিয়েছে। আবার পানামা খাল কাটার ফলে হর্ন অন্তরীপ বাণিজ্যিক পথের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।
পানামা খাল পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব
পানামা খাল খননের ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা পূর্ব এশিয়া অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য বিস্তারে পানামা খাল পথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ খাল পথের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো।
১। দূরত্ব হ্রাস
পানামা খাল খননের ফলে বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের সাথে ১২৫৯৬ কিলোমিটার দূরত্ব হ্রাস পেয়েছে। এটি উভয় এলাকার বাণিজ্যে এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
২। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য
এ খাল খননের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়তা করেছে। যেমন নিউইয়র্ক থেকে চিলির দূরত্ব প্রায় ৬১১৮ কিলো মিটার কমেছে।
৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাণিজ্য
পানামা খালপাথ শিল্প সমৃদ্ধ জাপান এবং কৃষি সমৃদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের বন্দর গুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পানামা খাল নিউইয়র্ক হতে ইয়কোহামার দূরত্ব প্রায় ৫৪৪৭ কিলোমিটার হ্রাস করেছে।
৪। উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য
পানামা খাল পথ দ্বারা উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল এবং এশিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী দেশসমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথ সহজ তর হয়েছে।
৫। ইউরোপ ও আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল বাণিজ্য
পানামা খালপথ দ্বারা ইউরোপের আটলান্টিক উপকূলের সাথে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় বন্দর গুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, লিভারপুল থেকে সানফ্রান্সিকোর দূরত্ব ৮ হাজার কিলোমিটার কমেছে।
৬। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য
পানামা খাল পথ নিউইয়র্ক ওয়েলিংটন এবং সিডনির সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এখান পথের ধারা নিউইয়র্ক হতে সিডনির দূরত্ব ৬২২৮ কিলোমিটার হ্রাস করেছে।
৭। জ্বালানি সংগ্রহ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যাপ্ত কয়লা ও পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায় বলে জাহাজগুলো সস্তায় প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংগ্রহ করে থাকে।
৮। সামরিক গুরুত্ব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ খালের সামরিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কেননা যুদ্ধজাহাজ গুলো অনায়াসে আটলান্টিক মহাসাগর হতে প্রশান্ত মহাসাগরে গমন করতে পারে।
৯। অর্থনৈতিক তৎপরতা
এ খাল পথটি উন্মুক্ত হওয়ায় ক্যারিবিয়ান উপকূলীয় দেশগুলো তথা কিউবা, হাইতি, বাহামা, পোর্টেরিকা প্রভৃতি দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, পানামা খালপথ বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্যারিবিয়ান সাগরকে প্রশান্ত-মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত করায় খরচ ও সময় দুই সাশ্রয় হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল গুলোর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পানামা খালপাথ অত্যান্ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
লেখকের মন্তব্য,
এই প্রতিবেদনে, পানামা খালপথ কি পানামা খালের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এ বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। এ বিষয়টি নির্ভরযোগ্য ও তথ্যবহুল করার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই এবং পেপার পত্রিকার সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে। ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য জানার জন্য আগ্রহী হলে নিয়মিত আমাদের এই ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন। আপনাকে ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url