সুয়েজ খাল কি, সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব সমূহ
প্রিয় পাঠক, সুয়েজ খাল কি, সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী, এ বিষয় সম্পর্কিত সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক ও ওয়েবসাইট খাটাঘাটি করছেন? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই আর্টিকেলটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে সুয়েজ খাল কি, সুয়েজ খালের অবস্থান, বৈশিষ্ট্য, ব্যবস্থাপনা, এর বিভিন্ন শাখা, উল্লেখযোগ্য বন্দর, এর সুবিধা, অসুবিধা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
ভূমিকা
জলপথ মানুষের প্রাচীনতম যোগাযোগের মাধ্যম। সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে মানুষ যাতায়াত পণ্য পরিবহনের জন্য পানিপথ ব্যবহার করেছে। তখন নৌকাই ছিল পানিপথের প্রধান যানবাহন। ১৮ শতকের পূর্ব পর্যন্ত পানিপথই ছিল পণ্য পরিবহনের একমাত্র পথ। রেল ও মটর উদ্ভাবনের পর স্থলপথের তুলনায় পানি পথের গুরুত্ব হ্রাস পেলেও সুলভতম পরিবহন মাধ্যম হিসাবে আজও পৃথিবীর বহু দেশে এটি একমাত্র অবলম্বন। এছাড়াও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য পরিবহন মাধ্যম হিসেবে যেসব পথ ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে জলপথ অন্যতম।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের দূরত্ব হ্রাস করে দুইটি মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য কৃত্রিম উপায়ে মানুষদের নৌপথ খনন করে তাকে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক খাল বলে। যেমন-
১। সুয়ের খালপথ (Suez Canal Route) ও
২। পানামা খালপাথ (Panama Canal Route)।
১। সুয়ের খালপথ (Suez Canal Route)
যে সামুদ্রিক খাল ভূমধ্যসাগরকে সুয়েজ যোজকের মধ্যে দিয়ে সুয়েজ উপসাগর তথা লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে, তাকে সুয়েজ খাল বলে। এটি মিশরের মূল ভূখণ্ডকে সিনাই উপদ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে স্পষ্ট ভূখণ্ডগত যোগাযোগ অপসারিত হয়েছে। সুয়েজের উৎসব মুখ থেকে খালটির উৎপত্তি হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে সুয়েজ খাল (Suez Canal)।
বিখ্যাত ফরাসি প্রকৌশলী ফার্ডিনাল্ড ডি লেসেপস এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৫৯ সালে এই খালের খনন কাজ আরম্ভ হয় এবং দীর্ঘ ১০ বছর খননের পর ১৮৬৯ সালে এই খনন কাজ শেষ হয়। তারপর ১৮৬৯ সালের নভেম্বর মাসে জাহাজ চলাফলের জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়। ফলে ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে এশিয়া অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকান দেশগুলোর দূরত্ব ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এর গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সুয়েজ খালের অবস্থান (Location)
ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বন্দর পোর্ট সৈয়দ থেকে সুই এর উপসাগরীয় বন্দর পোর্ট তৌফিক পর্যন্ত বিস্তৃত এই খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৬ কিলোমিটার হলেও মূল খননকৃত খালটি মাত্র ১০৬ কিলোমিটার। অবশিষ্ট প্রায় ৩০ কিলোমিটার বিটার হ্রদ, তিমসা হ্রদ ও বালা হ্রদ এর মধ্যে দিয়ে গেছে। মূলত এই তিনটি হ্রদকে সংযুক্ত করার মধ্যে দিয়েই সুয়েজ খালা আরম্ভ হয়। সুয়েজ খালের সর্বনিম্ন প্রস্থ প্রায় ৪৬ মিটার এবং ন্যূনতম গভীরতা প্রায় ১১ মিটার। সুয়েজ খালের তলদেশের বিস্তার কমপক্ষে ৬০ মিটার। ফলে অতি সহজে দুই খানা বিশাল আকৃতির জাহাজ পাশাপাশি চলতে পারে।
সুয়েজ খালের বৈশিষ্ট্য (Charecteristics)
যোগাযোগ ব্যবস্থা দিক দিয়ে সুয়েজ খালপথ বিশ্বের সামুদ্রিক পথগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এর বৈশিষ্ট্য গুলো হল-
- সুয়েজ খাল পথের উভয় পারশে বালিমাটি থাকায় জাহাজগুলো অতি ধিরগতিতে চলতে হয়।
- এই খালপথে পাশাপাশি দুইটি জাহাজ চলাচল করতে পারে।
- প্রতিটি জাহাজ এই খালপথটি অতিক্রম করতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে।
- বৈদ্যুতিক আলোর সুব্যবস্থা থাকায় খালটিতে দিবারাত্রি জাহাজ চলাচল করতে পারে।
- সুয়েজ খাল পথের শুল্কহার তুলনামূলক বেশি।
সুয়েজ খালের ব্যবস্থাপনা (Management of Suez Canal)
প্রথম দিকে খালটি মিশর ও ফরাসি সরকারের কর্তৃত্ব গঠিত সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ১৯৭৫ সালে ব্রিটিশ সরকার মিশরের সমুদয় শেয়ার ক্রয়ে করে খালের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের ১৬ জুলাই মিশর সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরাইল একযোগে মিশর আক্রমণ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা কিছু হেঁটে যায়। ফলে তখন থেকে খালের মালিকানা এবং পরিচালনার ভার সম্পূর্ণ মিশরের (The Suez Canal Authority)। সুয়েজ পথে যাতায়াতের জন্য প্রতিটি জাহাজকে উচ্চ হাড়ে শুল্ক দিতে হয়। এর পরিমাণ প্রায় বিশ হাজার ডলার।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে দীর্ঘ ৮ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৭৫ সালের ৫ই জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় এটি নৌ-চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পূর্বে ৪০ হাজার টন মাল বহন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ এ পথে যাতায়াত করতে পারত। কিন্তু নতুন করে সংস্কারের ফলে এই পথে বর্তমানে ৬০ হাজার টনেরও বেশি মালামাল ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ চলাচল করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার কাজ করতে থাকলে আশা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই ২৫ লক্ষ টন এর বেশি মাল বহন ক্ষমতা সম্পন্ন বিশালাকৃতির তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও এ পথে চলাচল করতে পারবে।
সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল (Ship Movement)
সুয়েজ খাল দিয়ে দৈনিক কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ টি জাহাজ যাতায়াত করে। ভূমধ্যসাগর থেকে খালের প্রবেশের মুখে পোর্ট সৈয়দ এবং লোহিত সাগর থেকে উপসাগর হয়ে খালের প্রবেশের মুখে বাম দিকে পোর্ট সুয়েজ এবং ডান দিকে পোর্ট তৌফিক অবস্থিত। ফলে চলাচল করে জাহাজগুলো সহজে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও অন্যান্য কাজকর্ম সেরে নিতে পারে। সুয়েজ পথে বছরে গড়ে প্রায় ২ কোটি ম্যাটট্রিকটন পণ্যদ্রব্য এবং অসংখ্য যাত্রীসহ প্রায় ১৪ / ১৫ হাজার জাহাজ চলাচল করে। এদের মধ্যে লাইনার, ট্যাঙ্কার ও ট্রাম্প অন্যতম।
সুয়েজ খালের শাখা সমূহ (Branches of Suez Canal)
লোহিত সাগরের দক্ষিণ তীরের এডেন বন্দর থেকে এই পথটি তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। যথা-
(I) প্রথম শাখা পূর্ব আফ্রিকার বন্দর গুলো হয়ে ডারবান বন্দরে,
(II) দ্বিতীয় শাখা পাক-ভারতের করাচি ও মুম্বাই বন্দরে এবং
(III) তৃতীয় শাখা কলম্ব গিয়ে আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে-
(A) এর প্রথম ও প্রধান শাখা মাদ্রাজ, কলকাতা, মংলা, চট্টগ্রাম, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপমালার ইন্দোনেশিয়া এবং দূরপ্রাচ্যের ফিলিপাইন, চীন হয়ে জাপান পর্যন্ত গেছে।
(B) দ্বিতীয় শাখা কলম্ব থেকে সোজা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বন্দরগুলোতে পৌঁছেছে।
সুয়েজ খালের উল্লেখযোগ্য বন্দর সমূহ (Main Ports)
এই সমুদ্রপথে অবস্থিত বন্দর গুলোর মধ্যে আটলান্টিক উপকূলের নিউইয়র্ক, ব্লাল্টিমোর, বোষ্টান, লন্ডন লিভারপুল, সাউদমটন, হামবুর্গ, আমস্টার্ডম, এন্টাওয়ার্প, লে-হাভার, লিসবন।
ভূমধ্যসাগর উপকূলের জিব্রাল্টার, বারসিলোনা. জেনোয়া, নেপলস, ভেনিস, আলেকজান্দিয়া, এথেন্স, পোর্ট সৈয়দ, বৈরুত।
কৃষ্ণসাগর উপকূলের বাটম,ওডেসা, কনেস্টানটাইন, ইস্তাবুল। লোহিত সাগর উপকূলের জেদ্দা। আরব সাগর উপকূলের ডারবান, মোজাম্বিক, জানজিবার, মুমবাসা, এডেন, বসরা, করাচি, মুম্বাই, কলম্বো।
বঙ্গপোউপসাগর উপকূলের মাদ্রাজ, বিশালাপত্তন, কলকাতা, মংলা, চট্টগ্রাম, রেঙ্গুন।
প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ,সাইগন, হংকং, ক্যান্টন, সাংহাই, টোকিও, ইয়াকোহামা, ম্যানিলা, জাকার্তা, সিডনি, মেলবন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সুয়েজ খালের পরিবাহিত পণ্য (Transported Commodities)
সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২৫% বাণিজ্যিক পণ্য পরিবাহিত হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৮৫% এর ওপর খনিজ তেল, ১০% খাদ্যশস্য, রাবার, দুদ্ধজাত দ্রব্য, তুলা, পাট ইত্যাদি এবং ৫% খনিজ পদার্থ ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য।
পরিবাহিত পণ্যগুলোর মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে খাদ্যদ্রব্য, সৌখিন, ভোগ্যপণ্য, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্যদ্রব্য। মধ্যপ্রাচ্য থেকে খনিজ তেল, পাকিস্তান থেকে তুলা, ভারত থেকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তামাক, তুলা, আক্ষরিক লোহা, বাংলাদেশ থেকে চা, চামড়া, পাট ও পাট-জাত দ্রব্য,শ্রীলংকা থেকে চা ও রবার, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন থেকে চাউল ও কাঠ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে রাবার, পেট্রোলিয়াম, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে গম, মাংস, জাপান, করিয়া ও চীন থেকে শিল্পজাত পণ্য, মোটর গাড়ি প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পথে রপ্তানি করা হয়।
সুয়েজ খালের সুবিধা (Merits of Suez Canal)
১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে এশিয়া অস্ট্রেলিয়ায় আসতে হলে উত্তমাশা অন্তরীপ পথে তথা সমগ্র আফ্রিকা উপকার ঘুরে আসতে হতো। অথচ ওই পথটি ছিল বিপদসংকুল। তাই সুয়েজ খাল খনন করা হয়। সুয়েজ পথ চালু হওয়ার ফলে নিম্নোক্ত সুবিধা গুলো পাওয়া যাচ্ছে-
- এ পথের উভয় প্রান্তে অবস্থিত দেশগুলো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিভিন্ন প্রকার শিল্প সম্পদের সমৃদ্ধ। ফলে এ খালের মধ্যে দিয়ে উভয় প্রান্তের দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
- এটি ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দূরত্ব ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কম খরচে ও দ্রুত যাতায়াত করা সম্ভব হচ্ছে।
- এ পথের মাঝখানে অসংখ্য উন্নত বন্দর থাকায় চলাচলকারী জাহাজগুলো সহজে মালামাল উঠানামা ও জ্বালানি গ্রহণ করতে পারে।
- এ পথে অসংখ্য যাত্রীবাহী ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে, ফলের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ছাড়াও পরোক্ষভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ইত্যাদি বিনিময় সহজ হয়েছে।
- এ পথে জাহাজ চলাচলের দূরত্ব কমে যাওয়াই কম ভাড়ায় পণ্যদ্রব্য বহন সম্ভব হচ্ছে বলে ক্রেতাগণ খুব কম মূল্যে ও কমসময়ে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য পেয়ে থাকে।
এছাড়া রাশিয়া, ব্রিটিশ ও আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজগুলো অতিদ্রুত এ পথে চলাচল করতে পারে।
সুয়েজ খালের অসুবিধা (Demerits of Suez Canal)
সুয়েজ খালের অসুবিধা গুলো নিম্নরূপ-
- এ পথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে উচ্চাহারে কর দিতে হয়।
- এ পথে বড় বড় জাহাজ চলার পক্ষে অপেক্ষাকৃত সরু ও অগভীর।
- এ খালটির উভয় পাশে বালি থাকায় জাহাজগুলোকে নিয়ন্ত্রিত গতিতে ধীরে ধীরে চলতে হয়। মাত্র ১৬৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা সময় লেগে যায়।
- এ পথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে বিভিন্ন প্রকার বাধা নিষেধ ও নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ফলে অনেক জাহাজই উত্তমাশা আন্তরিপ ঘুরে যাতায়াত করে। তবে বর্তমানে নিয়ম কানুন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
সুয়েজ খাল পথের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব
সুয়েজ খাল পথটি খনন করার পর স্বল্প খরচে ও কম সময়ে পণ্যদ্রব্য বিভিন্ন দেশের ভোক্তার নিকট পৌঁছে দিতে সুবিধা হয়। খালটি খননের ফলে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব কমেছে। এর ফলে এটি বিশ্ববাণিজ্যে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে দিয়েছে। নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের আলোকে সুয়েজ খাল পথের গুরুত্ব আলোচনা করা হল-
১। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি
সুয়েজ খালের সাহায্যে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের সাথে পূর্ব আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে সুনিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে প্রাচ্যের দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
২। দূরত্ব হ্রাস
পূর্বে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ পথ ঘুরে যেতে দীর্ঘ সময় লাগতো। ফলে অনেক ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হত। কিন্তু এই খালটি চালু হওয়ার পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সাথে উত্তর আমেরিকার এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জল পথের দূরত্ব যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ লন্ডন থেকে করাচি পর্যন্ত ৪৫৩০, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ৩০০০, সিডনি পর্যন্ত ১০০০, নটিক্যাল মাইল দূরত্ব কমে যায়।
৩। উন্নত বন্দরের সুবিধা
এ খাল পথে চলাচলকারী জাহাজগুলো মূলত এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকা হতে ইউরোপ ও আমেরিকার বন্দরগুলোতে চলাচল করে। এতে করে পথিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বন্দরের মাল উঠানামা করার সুযোগ পায়। উল্লেখযোগ্য বন্দরগুলো হল-কলম্ব, করাচি, চেন্নাই, এডেন, আলেকজান্দ্রিয়া, লন্ডন, লিভারপুল প্রভৃতি।
৪। জ্বালানি সুবিধা
জাহাজ চলাচলের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জ্বালানি, আর তা সুয়েজ খাল পথের উভয় পার্শ্বে প্রচুর পাওয়া যায়। কারণ, এ পথের পার্শ্ববর্তীতে রয়েছে পৃথিবীর খনিজ তেলের বিশাল সম্ভার, বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, মিশর প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে পশ্চিম ইউরোপের কয়লা সম্পদ।
৫। পণ্য প্রাপ্তির সুযোগ
সুয়েজ খাল পথের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো জনবহুল ও সম্পদশালী। জাহাজগুলো এসব দেশের পার্শ্ব দিয়ে যাওয়ার পথে প্রচুর যাত্রী ও পণ্য পায়। হলে জাহাজ গুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। দূরত্ব ও সময় কমে যাওয়ায় এবং ভালো সুযোগ সুবিধা থাকাই ভোক্তাগণ পূর্বের চেয়ে ভালো পণ্য পেয়ে থাকে।
৬। জাহাজ চলাচলের সুবিধা
এ পথটি সামুদ্রিক জাহাজ চলাচলের জন্য অধিক নিরাপদ। কারণ এ পথে বাধা বিঘ্ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুবই কম।এর কারণে ইউরোপের জাহাজগুলো চলাচলের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, এ পথে বার্ষিক ১৭/১৮ হাজার জাহাজ চলাচল করে এবং এদের পরিবর্তিত পণ্যের পরিমাণ ৩.৫ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি।
৭। তেল ব্যবসায়ীর সুবিধা
আন্তর্জাতিক তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এই পথ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তেল ভান্ডার আহরণ ও বিতরণের জন্য এ পথ ব্যবহার হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ এ খাল পথেই তাদের প্রয়োজনীয় তেল আমদানি করে থাকে। ইউরোপ মহাদেশের মোট প্রয়োজনীয় আমদানি তেলের প্রায় ৮৫% এ পথের সম্পন্ন হয়।
৮। বাণিজ্যিক পণ্যদ্রব্য আদান-প্রদান
প্রাচ্যের দেশগুলো কৃষি নির্ভর, অপরদিকে পাশ্চাত্যের দেশগুলো শিল্পনির্ভর হওয়ায় উভয় অঞ্চলের মধ্যে একে অপরের চাহিদা মেটানোর তাগিদে নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ পথের মাধ্যমে প্রাচ্যের দেশগুলো হতে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য, খনিজ দ্রব্য এবং শিল্পের কাঁচামাল পাশ্চাত্যের দেশগুলো তে প্রেরণ করা হয়। অপরদিকে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো হতে শিল্পজাত দ্রব্য, কলকব্জা, ঔষধপত্র প্রভৃতি প্রাচ্যের দেশসমূহে রপ্তানি করা হয়।
৯। রাজস্ব প্রাপ্তির সুবিধা
১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার পর মিশরে এই খাল পথ থেকে প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব পেয়ে থাকে। মিশর প্রতিবছর এই খাল পথ থেকে প্রায় ৩০ কোটি ডলার মুদ্রা অর্জন করে। এছাড়া এ পথের পাশাপাশি দেশগুলোও এর থেকে প্রচুর শুল্ক পেয়ে থাকে।
১০। উন্মুক্ততা
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধ ও শান্তি উভয় সময়েই এই পথে সকল দেশের জাহাজ নিরাপদে চলাচল করতে পারে। এছাড়া বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের যুদ্ধজাহাজগুলো এ পথে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরের দ্রুত চলাচল করে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুয়েজ খালের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়াই বর্তমানে মিশর সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এর ব্যাপক সম্প্রসারণ কাজে হাত দিয়েছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এই পথ দিয়ে বিরাট আকৃতির ২ লক্ষ ৫০ হাজার টন মালবহন ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ চলাচল করতে পারবে।সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সুয়েজ খাল প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে।
মন্তব্য,
আজকের প্রতিবেদনে সুয়েজ খাল কি, সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব সমূহ আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের বই পুস্তক অনুসরণ করা হয়েছে, যেন প্রতিবেদনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরশীলতা লাভ করে। এ বিষয়ে যদি কারো মন্তব্য থাকে তবে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এ ওয়েবসাইটের এডমিন প্রতিটা কমেন্টসের জবাব দিয়ে থাকে। আপনাকে ধন্যবাদ।।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url