চ্যুতি কাকে বলে চ্যুতির প্রকারভেদ এবং চ্যুতির দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ
প্রিয় পাঠক, আপনি কি চ্যুতি কাকে বলে চ্যুতির প্রকারভেদ এবং চ্যুতির দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য জানতে খুব আগ্রহী, এই বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করছেন অথবা বিভিন্ন লেখকের বই খোঁজাখুঁজি করছেন, কোনটি অনুসরণ করবেন সে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না? তাহলে আপনার জন্য এই আর্টিকেলটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে চ্যুতি কাকে বলে, চ্যুতি কত প্রকার, চ্যুতির ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন চ্যুতি সম্পর্কিত অনেক বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।
ভূমিকা
ভূআন্দোলনের ফলে শিলাস্তরের কোথাও বেঁকে যায়, কোথাও উপরে উত্থিত হয়, কোথাও নিচের দিকে বসে যায়। আবার প্রচন্ড চাপে এক শিলাস্তর অপর শিলাস্তরের উপর উঠে যায়। ভূআন্দোলনের তারতম্যের জন্যই এসব ভূমিরূপে সৃষ্টি হয়। সংকোচন ও সম্প্রসারণ আলোড়নের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে যে পরিবর্তন দেখা যায় তার মধ্যে চ্যুতি (Fault) উল্লেখযোগ্য।
চ্যুতি (Faulting) কাকে বলে
কোন ফাটলের উভয় পাশের ভূ-খণ্ড বা শিলাস্তরে যদি আপেক্ষিক স্থানান্তর হয়, তখন তাকে চ্যুতি (Fault) বলে। ভূত্বকের ওপর প্রতিনিয়ত ভুসংস্থানিক প্রক্রিয়া কাজ করে চলেছে। এর ফলে কোথাও সংকোচন আবার কোথাও সম্প্রসারণ বল কাজ করছে। এর ফলে শিলাস্তরে ফাটল তৈরি হয় এবং ফাটল বরাবর একটি ভূখণ্ড ওপরে উঠে আসে ও অপরটির নিচে বসে যায়। এভাবে একটি চ্যুতির (Fault) সৃষ্টি হয়।
যে আনুভূমিক রেখা বরাবর চ্যুতি সংঘটিত হয় তাকে চ্যুতি রেখা (Fault Line) বলে এবং যে তল বরাবর শিলার স্থানচ্যুতি ঘটে তাকে চ্যুতি তল (Fault Plane) বলে। চ্যুতি খাড়া, আনুভূমিক, বাঁকা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। চ্যুতিতল এবং আনুভূমিক তলের সংযোগস্থলের কোণকে চ্যুতিকোণ (Fault Dip) বলে। সাধারণত চ্যুতির ফলে শিলারাশির যে অংশ উপরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে তাকে ঝুলন্তপ্রাচীর এবং চ্যুতির উত্থিত পাশের ঢালকে চ্যুতিঢাল বলা হয়।
চ্যুতির ধরন বা প্রকারভেদ (Type of Fault)
চ্যুতিতল, চ্যুতিরেখা, নতিমাত্রা, চ্যুতিকোন, উলম্ব ব্যবধান, ব্যাপ্তি এবং চ্যুতির আপেক্ষিক গতি ও প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন প্রকার চ্যুতি দেখা যায়। নিচে কয়েকটি চ্যুতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। স্বাভাবিক চ্যুতি (Normal Fault)
কোন স্থানে ভুভাগ থেকে যদি কোন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে অবনমিত হয় তখন তাকে স্বাভাবিক চ্যুতি (Normal Fault) বলে। যখন কোন চ্যুতির নিম্ন দেওয়াল উপরে উত্থিত হয় বা ঝুলন্ত দেওয়াল নিম্নে অবতরণ করে তখন স্বাভাবিক চ্যুতির সৃষ্টি হয়। এ ধরনের চ্যুতিতে চ্যুতিতল অবতল পার্শ্বের দিকে ঢালু থাকে। স্বাভাবিক চ্যুতির ক্ষেত্রে সাধারণত ভূ-ভাগ যেদিকে বসে যায় চ্যুতিতলের নতি ও সেদিকে থাকে এবং চ্যুতিতলটি সেদিকে খুব খাড়া ভাবে হেলে থাকে।
২। বিপরীত চ্যুতি (Reverse Fault)
এটি স্বাভাবিক চ্যুতির ঠিক বিপরীত। বিপরীত চ্যুতিতে ঝুলন্ত দেয়াল ওপরে উঠে যায় অর্থাৎ ভূ আন্দোলনের ফলে কোন খণ্ডের পার্শ্ববর্তী অংশ উপরে উঠে গেলে বিপরীত চ্যুতির সৃষ্টি হয়। ঝুলন্ত দেওয়াল যদি অবনত পার্শ্বের উপর অধিক হেলে থাকে তখন তাকে নিক্ষেপ বলে। এজন্য কেউ কেউ বিপরীত চ্যুতিকে নিক্ষেপ চ্যুতি নামে অভিনীত করে থাকেন। এরূপ চ্যুতিতে চ্যুতিতলের একদিকের শিলারাশি অপরদিকে শিলারাশির উপর উঠে গিয়ে খাড়াভাবে ঝুলন্ত ভূখণ্ডের মত অবস্থান করে বলে মনে হয়।
৩। ছিন্নচ্যুতি (Tear Fault)
ছিন্নচ্যুতি হচ্ছে একটি উলম্ব ফাটল। কিন্তু এক্ষেত্রে চ্যুতিতলের একপাশে আপেক্ষিক ভাবে অন্যপাশ থেকে উলম্বভাবে অপসারিত হবার পরিবর্তে অনুভূমিকভাবে একই তলে স্থানান্তরিত হয়। মনে হয় যেন এক দিকের শিলারাশির অপর দিকে শিলারাশির গা ঘেঁষে একই তলে দূরে সরে গেছে। এই চ্যুতির কোন উলম্ব ব্যবধান হয় না।
৪। অর্পিত চ্যুতি (Thurst Fault)
যখন দুইটি শক্তি পরস্পরের দিকে সক্রিয় হয় তখন তাকে সংনমন বলে। সংনমনের ফলে ভূপৃষ্ঠ সংকুচিত হয়ে বিভিন্ন আকৃতির ভাঁজ ও বিপরীত চ্যুতির সৃষ্টি করে। সংনমন শক্তির প্রভাবে অর্ধশায়িত ভাঁজের মধ্যে যখন চ্যুতি সংঘটিত হয় তখন তাকে অর্পিত চ্যুতি চুক্তি বলে।
৫। শায়িত চ্যুতি (Overthrust Fault)
চ্যুতিতলের একপাশের শিলাস্তর যখন অপর পাশের শিলাস্তরের উপর পাতলা পাতের মতো অতিক্ষুদ্র কোনে হেলে অবস্থান করে তখন তাকে শায়িতচ্যুতি বলে। প্রবল সংনমন শক্তির প্রভাবে এরূপ চ্যুতি অনুষ্ঠিত হয়।
৬। ধাপ চ্যুতি (Step Fault)
একই সমতলে কয়েকটি চ্যুতি পর পর সমান্তরালে অবস্থান করলে সেখানে ধাপ বিশিষ্ট যে ভূপ্রকৃতির উদ্ভব হয় তাকে ধাপ চ্যুতি বা সোপান চ্যুতি বলে। ধাপ চ্যুতি দেখতে অনেকটা সিড়ির মত মনে হয়। কতিপয় স্বাভাবিক চ্যুতি একত্রে অবস্থান করলে ও অনেক সময় এরূপ চ্যুতির সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৭। শাখায়িত চ্যুতি (Branching Fault)
যখন একটি প্রধান চ্যুতিকে কেন্দ্র করে শাখা দুই বা ততোধিক শাখা চ্যুতির সৃষ্টি হয় তখন তাকে শাখায়িত চ্যুতি বলে। এ ধরনের চ্যুতি অঞ্চল খুবই দুর্বল থাকায় ক্ষয় সাধনের প্রভাব অত্যন্ত বেশি থাকে। অত্যাধিক ক্ষয়ক্রিয়ার কারণে এ ধরনের চ্যুতি দীর্ঘ সময়কাল বহাল নাও থাকতে পারে।
চ্যুতির ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ (Landforms Produced by Faulting)
ভূত্বকে বিভিন্ন প্রকার চ্যুতি সংঘটিত হাওয়ায় ভূমিরূপের উপর তার ব্যাপক প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।চ্যুতির ফলে কোন এলাকার ভূমি উপরে ওঠে, নিচে নামে, হেলে থাকে বা কখনো কখনো সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। চ্যুতির ফলে শিলাস্তর ভেঙ্গে যায় এবং সেই ভাঙ্গা জায়গার শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কোন স্থানে কেবলমাত্র একটি চ্যুতি দেখা যায় না, একই স্থানে অনেকগুলি চ্যুতি অবস্থান করে। এর ফলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ গঠিত হয়। নিচে চ্যুতির ফলে সৃষ্ট কয়েকটি বিশেষ ধরনের ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। স্তুপ পর্বত (Horst or Block Mountain)
দুইটি চ্যুতির মধ্যবর্তী শিলাস্তার পার্শ্ববর্তী স্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উর্ধ্বচাপের ফলে উপরে উঠে যায়। আবার কখনো কখনো চ্যুতির ফলে পার্শ্ববর্তী ভূ-ভাগদয় মধ্যবর্তী ভুভাগের চেয়ে নিচে বসে যাওয়ার ফলে মধ্যের অংশ উঁচু পর্বত আকারে অবস্থান করে। এরূপ উন্নত ভূ-ভাগ হোস্ট বা স্তুপ পর্বত নামে পরিচিত। মধ্য ইউরোপের ভোজ, ব্ল্যাক ফরেন্ট প্রভৃতি হারসিনিও পর্বত, মধ্যপ্রাচ্যে সুয়েজ ও আকাবা চ্যুতির মধ্যবর্তী সিনায় প্রভৃতি স্তুপপর্বত গুলির মধ্যে অন্যতম।
২। স্রস্ত বা গ্রস্থ উপত্যকা (Rift Valley)
দুইটি চ্যুতির মধ্যবর্তী অংশ নিচে বসে গিয়ে যে উপত্যকার সৃষ্টি করে তাকে স্রস্ত উপত্যকা বলে। পশ্চিম এশিয়ার জর্ডান নদীর উপত্যকা ও মরু সাগর, পূর্ব আফ্রিকার নেয়ামা, টাঙ্গানাইকা প্রকৃতির হ্রদ, ইউরোপের বাহরাইন নদীর উপত্যকা এবং ভারতের নর্দমা নদীর উপত্যকা স্রস্ত উপত্যকার উদাহরণ।
৩। ভ্রষ্ট উপত্যকা (Ramp Valley)
কোন শিলাখণ্ডের উভয়দিকে প্রায় সমান্তরাল চ্যুতিতলে ভূমিখণ্ড উৎখিত হলে ভ্রষ্ট উপত্যকার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ কোন শিলাস্তরের উভয়পাশ বাইরের দিকে হেলে উপরে উঠে গেলে যে অবনত অংশ থাকে তাকে ভ্রষ্ট উপত্যকা বলে।
৪। গ্রাবেন (Graben)
ধাপচ্যুতি শ্রেণীবদ্ধভাবে দুই পার্শ্ব হতে এসে মিলিত হয়ে সরু পরিখার ন্যায় ভূমিরূপ সৃষ্টি করলে তাকে জার্মান ভাষায় 'গ্রাবেন' বা পরিখাচ্যুতি বলে। মূলত এটি হচ্ছে কতিপয় সমান্তরাল চ্যুতি দ্বারা বেষ্টিত একটি কাঠামো যা উপত্যকার মতো দেখতে কিন্তু উপত্যকা নাও হতে পারে। জার্মানির রাইন নদীর উপত্যকা এর উদাহরণ।
৫। একনত বাঁক (Monoclinal Flexing)
ভু-আলোড়নের ফলে শিলাস্তরের উপর অংশ এবং নিচের অংশের মধ্যবর্তী শিলাস্তরের কোন ফাটল সৃষ্টি না হয়ে অনেক সময় বাঁকের সৃষ্টি হয়। এরূপ কাঠামোকে একমত বাঁক বলে।
৬। ভৃগুতট (Scarp)
কোন চ্যুতির ওপরের অংশের শিলারস্তর এবং নিচের অংশের শিলাস্তরের মধ্যে অবস্থিত খাড়া ঢালু অংশকে চ্যুতি ভৃগুতট (Fault Scarp) বলে। অবশ্য চ্যুতি ছাড়াও অন্যভাবে, বিশেষ করে বৈষম্যমূলক ক্ষয়ীভবনের ফলেও ভৃগুতট বা প্রণবভূমি উদ্ভব লাভ করতে পারে।
৭। বিপ্রতীপ ভৃগুতট চ্যুতি (Obsequent Scarp Fault)
স্রোতধারার ক্ষয় কাজের ফলে অনেক সময় ভৃগুতটের আকৃতি পরিবর্তিত হয়। ভৃগুতটের উঠে আসা অংশ নরম শিলা দ্বারা গঠিত হলে উঁচু অংশ থেকে অবনত অংশের দিকে প্রবাহিত অনবর্তী স্রোতধারা দ্রুত নরম শিলাকে ক্ষয় করে এবং কিছু কালের মধ্যে উন্নত অংশ অবনত অংশ অপেক্ষা নিচু হয়। ফলে স্রোতধারা বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়ে নরম শিলাকে আরো ক্ষয় করে। এরূপ ক্ষয়প্রাপ্ত চ্যুতি ভৃগুতট 'বিপ্রতীপ চ্যুতি ভৃগুতটে' পরিণত হয়।
৮। পুনরানুবর্তী চ্যুতিরেখা ভৃগুতট (Resequent Fault Line Scarp)
স্রোতধারার ক্ষয় কাজের ফলে চ্যুতি ভৃগুতটের অপেক্ষাকৃত শক্ত অংশ ও ক্ষয়ীভুত হয় এবং উভয় অংশ এক সমতলে পৌঁছায়। পরবর্তী সময়ে অপেক্ষাকৃত নরম শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হলে অপেক্ষাকৃত শক্ত শিলা পুনরায় উঁচু হয় এবং বিপ্রতীপ স্রোতধারা গতি পরিবর্তন করে আবার অনুবর্তী স্রোতধারায় পরিণত হয়। এই পর্যায়ে ভৃগুতটকে 'পুনরানুবর্তী চ্যুতিরেখা ভৃগুতট' বলে।
মন্তব্য
আজকে এই প্রতিবেদনে চ্যুতি কাকে বলে চ্যুতির প্রকারভেদ এবং চ্যুতির দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ সম্পর্কিত শিরোনামে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। তথ্যগুলো নির্ভরযোগ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুনামধন্য লেখকের বই অনুসরণ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন সম্পর্কিত কোন মন্তব্য থাকলে কমেন্টস বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এই ওয়েবসাইটের এডমিন প্রতিটা কমেন্টসের জবাব দিয়ে থাকেন। প্রতিবেদনটি মনোযোগের সহিত পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url