বিচূর্ণীভবন বলতে কি বুঝ বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়া সমূহ আলোচনা বিস্তারিত
প্রিয় পাঠক, বিচূর্ণীভবন বলতে কি বুঝ বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়া সমূহ আলোচনা বিস্তারিত সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী, এ বিষয়ে জানার জন্য কোন লেখকের বই অনুসরণ করবেন তা নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এ প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে বিচূর্ণীভবন বলতে কি বুঝ, বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়া সমূহ যেমন- রাসায়নিক ভবনযান্ত্রিক বিচূর্ণী ভবন (Mechanical Weathering), রাসায়নিক বিচূর্ণী ভবন (Chemical Weathering) ও জৈবিক বিচূর্ণী ভবন (Biological Weathering) সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। চলুন এবার বিস্তারিত দেখে নিই।
ভূমিকা
বিভিন্ন প্রকার বাহ্যিক প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা বহু বছর যাবত ভূপৃষ্ঠের যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে ধীর পরিবর্তন বলে। সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, নদীপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, সমুদ্রস্রোত, সমুদ্রতরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, তুষারপাত ইত্যাদির পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি। সুদীর্ঘ সময় ধরে ভূপৃষ্ঠের এই পরিবর্তন সংঘটিত হয় বলে এই প্রক্রিয়াগুলো সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না।
সাধারণত ধীর পরিবর্তনকারী শক্তিগুলোর অব্যাহত ক্ষয়ক্রিয়ার ফলে বৃহৎভূমিরূপ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। ধীর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন ভূমিক্ষয় প্রাপ্ত হয় অন্যদিকে আবার ভূমির গঠনের কাজ চলে। যে সমস্ত প্রক্রিয়ায় ভূমিরূপের ধীর পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলোকে প্রধানত ৫ টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিচূর্ণীভবন বা আবহবিকার।
বিচূর্ণীভবন বা আবহবিকার (Weathering)
শিলারাশির চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াকে বিচূর্ণ ভবন বলে। বিচূর্ণী ভবনের ফলে ভূত্বকের উপরিভাগের শিলারাশি ভেঙ্গে যায়, চূর্ণ বিচূর্ণ হয় এবং শিথিল হয়ে পড়ে। বায়ুর চাপ ও উত্তাপ আদ্রতা প্রভৃতি আবার উপাদানগুলির প্রভাবে ভূত্বকের শিলার এই পরিবর্তন সাধিত হয় বলে এই প্রক্রিয়াকে আবহবিকার নামে ও অভিহিত করা হয়। বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়াকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১। যান্ত্রিক বিচূর্ণী ভবন (Mechanical Weathering)
২। রাসায়নিক বিচূর্ণী ভবন (Chemical Weathering) ও
৩। জৈবিক বিচূর্ণী ভবন (Biological Weathering)
১। যান্ত্রিক বিচূর্ণী ভবন (Mechanical Weathering)
বাহ্যিক প্রাকৃতিক শক্তিগুলির দ্বারা শিলাস্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়াকে যান্ত্রিক বিচূর্ণী ভবন বলে। পর্বতের গায়ের কোন উচ্চ স্থান থেকে পাথর স্থানচ্যুত হলে তা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নিচের দিকে ধাবিত হয় এবং শিলারাশির সাথে সংঘর্ষে ভেঙ্গে যায়। স্থানচ্যুত শিলা অন্যান্য শিলার সাথে ঘাত প্রতিঘাতে নিজে হয় প্রাপ্ত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয় এবং অন্যান্য শিলারও ক্ষয় সাধন করে। এই রূপে বিচূর্ণীভূত শিলাখন্ডগুলির সূক্ষ্ম কোন বা ধারালো কিনারাযুক্ত হয়। যান্ত্রিক বিচূর্ণভবন প্রধানত নিম্নোক্তরূপে ঘটে থাকে। যথা-
(I) উষ্ণতার তারতম্য (Variations of Temperature)
(II) চাপ হ্রাস জনিত (Weathering by pressure release)
(III) কেলাস গঠনজনিত (Weathering by crystal growth) এবং
(IV) মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব (Influance of Gravity)
(I) উষ্ণতার তারতম্য (Variations of Temperature)
দিন-রাত্রির উষ্ণতা এবং ঋতু ভেদে উত্তাপের পার্থক্যের জন্য শিলাগুলি অসমান ভাবে সংকুচিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংকোচন ও সম্প্রসারণের ফলে শিলা খন্ড খন্ড হয়ে যায়। কোন কোন শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ক্ষুদ্র কোনায় পরিণত হয়। একে "সংকোচন-সম্প্রসারণ জাত বিচূর্ণীভবন বা তাপ বিচূর্ণ" বলে।
সূর্যতাপই উষ্ণতার উৎস। সূর্য তাপের কার্য যান্ত্রিক বিচূর্ণ ভবনের একটি অঙ্গ। বরফ জাতীয় কতিপয় পদার্থ ছাড়া সকল প্রকার কঠিন পদার্থের উপর সূর্যতাপ স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। ভূত্বকের শিলা গুলি নানা প্রকার খনিজ ও আকরিক পদার্থ গঠিত। এসব উপাদান একই উষ্ণতায় সমানভাবে প্রসারিত বা সংকুচিত হয় না। দিনের উত্তাপ এবং রাত্রির উত্তাপেও পার্থক্য রয়েছে। আবার প্রত্যেক স্থানেই শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে অধিক উত্তাপ অনুভূত হয়। উষ্ণতা ও শৈতের পার্থক্যের ফলে বিভিন্ন শিলার অভ্রান্তর ও বাইরের সংকোচন-সম্প্রসারণ এর পার্থক্যের জন্য শিলাগুলি বহিরাবরন ক্রমশঃ আলগা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল যাবত এইভাবে সংকোচন ও সম্প্রসনের ফলে কালক্রমে কঠিন শিলার বহিরাবরণ পিঁয়াজের খোসার মত খুলে যায়। একে শিলার "বল্কল মোচন" (Exfoliation) বলে।
বিচূর্ণ ভবনের ফলে বিভিন্ন শিলার বহিরাবরণ মূল শিলা থেকে স্তরে স্তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে কালক্রমে শিলা খণ্ড গুলিকে গোলাকৃতি রূপ দান করে। এরূপ বিচূর্ণীভূত গোলাকার বা প্রায় গোলাকার সেরা খন্ডকে "অবশিষ্ট শিলা" (Residdual Boulder) বলে।
বিভিন্ন খনিজের সমন্বয়ে শিলা গঠিত এবং সব খনিজ সমানভাবে সংকুচিত ও সম্পসারিত হয় না। ফলের শিলার মধ্যে বিভিন্ন টান সৃষ্টি হয় এবং উহা ফেটে যায়। শিলার মধ্যস্থিত বিভিন্ন সংযোগ সাধক পদার্থের মধ্যে দিয়ে ফাটলের সৃষ্টি হলে শিলাটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে "ক্ষুদ্রকণা বিশারণ" (Granular disintegration) বলে।
মরু অঞ্চলে সূর্যের প্রখর উত্তাপে শিলাস্তর যথেষ্ট প্রসারিত হয়। অনেক সময় এ অবস্থায় হঠাৎ প্রবল বৃষ্টিপাত হলে উত্তপ্ত শিলাস্তর দ্রুত শীতল ও সংকোচিত হবার সময় ফেটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিচূর্ণভবনকে "খন্ডিকরন" (Shattering) বলে।
সূর্যতাপে শিলার নিচের স্তর অপেক্ষা উপরের স্তর অধিক উত্তপ্ত হয় এবং শিলার মধ্যে পিড়ন চলতে থাকে। এই পিড়ন একটি নির্দিষ্ট সীমা অপেক্ষা অধিক হলে শিলার মধ্যে সমান্তরাল উলম্ব ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফলে শিলা বিভিন্ন প্রস্তর চাঁই আকারে বিচ্ছিন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিচূর্ণ ভবনকে "প্রস্তর চাঁই এ বিচ্ছিন্ন করণ" (Block Disintegration বা Joint Block Separation) বলে।
মরুভূমি বা শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে দিন-রাত্রির তারতমের জন্য সংকোচন-সম্প্রসারণের ফলে শিলারাশির উপরিভাগ ক্ষীণ স্তরে স্খলিত ও বিচূর্ণভুত হয়ে বালুকা বা কংকর এ পরিণত হয়। বিচূর্ণভুত এই শিলা পর্বতের ঢাল বেয়ে পাদদেশে স্তুপিকৃত হতে থাকে। একেই ইস্ত্রী বা স্ক্রি বা "টেলাস" (Tallus) বলে।
(II) চাপ হ্রাস জনিত (Weathering by pressure release)
সে নির্দিষ্ট চাপে উদবেধী আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও ভূগর্ভের রূপান্তরিত শিলা উৎপন্ন হয়েছিল বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে ওই চাপের স্থিতাবস্থা নষ্ট হয় এবং প্রতিনিয়ত ওই চাপের পরিবর্তন হতে থাকে। চাপ পরিবর্তনের তীব্রতা অনুযায়ী ওইসব শিলার টান ও পীড়ন অনুষ্ঠিত হয় এবং এর প্রভাবে শিলার বিচূর্ণীভবন হয়।
(III) কেলাস গঠনজনিত (Weathering by crystal growth)
দুইটি প্রক্রিয়ায় কেলাস গঠনজনিত বিচূর্ণীভবন সংঘটিত হতে দেখা যায়। যথা-
(ক) তুষার বিচূর্ণীভবন (Forst Weathering) এবং
(খ) লবণ বিচূর্ণীভবন (Salt Weathering)
(ক) তুষার বিচূর্ণীভবন (Forst Weathering)
শিলা স্তরের মধ্যের পানি তুষার বা বরফে পরিণত হয়ে বিচূর্ণীভবন ঘাটালে, তাকে তুষার বিচূর্ণীভবন বলে। তুষার যান্ত্রিক বিচূর্ণীভবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পানি হিমায়িত হলে এর আয়তন প্রায় ৯ ভাগ বেড়ে যায়। শিলার ফাটলের মধ্যে আবদ্ধ পানি তুষারের পরিণত হলে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১২৫ মিলিগ্রাম চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে তুষারপাত হয় এবং তুষারগলা পানি সময় ও ঋতু ভেদে তুষারে রূপান্তরিত হয় সেখানে তুষার বিচূর্ণীভবন অত্যান্ত প্রকটভাবে দেখা যায়। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে এই প্রক্রিয়ায় অনেক ছোট ছোট শিলাকণার সৃষ্টি হয়।
(খ) লবণ বিচূর্ণীভবন (Salt Weathering)
শিলাস্তরের লবণাক্ত পানি বাষ্পীভবনের ফলে লবনে রূপান্তরিত হয়ে বিচূর্ণীভবন ঘাটালে তাকে লবণ বিচূর্ণীভবন বলে। সামুদ্রিক বায়ু প্রবাহ যে লবণকণা বায়ুমণ্ডলের ছড়িয়ে দেয় বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে দ্রবীভূত হয়ে সেই লবণ ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। শুষ্ক অঞ্চলে এইরূপ দ্রবীভূত লবণ ভূমি ও শিলার মধ্যে প্রবেশ করে। উত্তাপের পরিমাণ বেশি থাকায় পানি দ্রুত বাষ্পভূত হয় এবং লবণ পড়ে থাকে। কেলাসিও লবণ শিলাস্তরের ছিদ্রগুলির পাশে অধিক চাপ দেয়। ফলের শিলার বিচূর্ণীভবন ঘটে। বেলেপাথরে লবণ বিচূর্ণীভবনের মাত্রা বেশি।
(IV) মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব (Influance of Gravity)
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পার্বত্য অঞ্চল থেকে পাথরখন্ড স্থানচ্যুত হয়ে নিম্নভিমুখে ধাবিত হয়। উপরের শিলা এইরূপে অপসারিত হলে নিচের শিলাগুলি নগ্নীভূত হয়। পতিত শিলার আঘাতে এর সাথে সাথে পাদদেশের শিলা ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। খাড়া পার্বত্য অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রশিলা খন্ডগুলি পর্বতের গা বেয়ে পাদদেশে জমা হয়ে থাকে। এইরূপে স্থানচ্যুত খন্ড শিলাগুলিকে "চ্যুত শিলা" (Slide Rocks) বলে।
অনুকূল অবস্থায় শিলারাশি পর্বত উপত্যকার মধ্যে দিয়ে স্রোতের আকারে ধীরগতিতে প্রবাহিত হয়। হিমবাহের ন্যায় অগ্রসর হয় বলে অনুরূপ অগ্রসরমান শিলা রাশিকে "শৈলিক হিমবাহ" (Rock Glscier) বলে।
মাধ্যাকর্ষণ এবং অন্যান্য শক্তির প্রভাবে অনেক সময় বৃহদাকৃতির শিলা বা শিলাস্তূপ ক্ষয়ীভূত হয়। একে "স্তূপক্ষয় বা ভার বিচলন" (Mass Wasting) বলে।
পর্বত বা পাহাড়ের ঢালের ভূমিখন্ড মৃত্তিকা বা শিলাস্তূপ ধ্বংসে পড়লে তাকে "ভূপাত বা ভূমিধস" (Land Slide) বলে।
পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়ই ভূপাত ঘটে থাকে। তবে পর্বতের গা যদি খাড়া না হয়, অথবা যদি পতনমুখ পদার্থ গুলি হালকা কিংবা কর্দমাক্ত হয় তাহলে ভূপাতের গতি খুব ধীর হয়। একে "ধীর গতি ভূপাত" (Creeping land Slide) বলে।
কিন্তু খাড়া ঢাল বিশিষ্ট অঞ্চলে ভূপাত দ্রুত গতিতে সংঘটিত হয়। তাকে "আকস্মিক ভূপাত" বলে।
২। রাসায়নিক বিচূর্ণী ভবন (Chemical Weathering)
বিভিন্ন খনিজ পদার্থ শিলাসৃষ্টিতে সাহায্য করে। অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয়বাষ্প বায়ু মন্ডলের উপাদান ওই খনিজ পদার্থের ওপর রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। এর ফলে শিলার যে বিয়োজন ও পরিবর্তন হয়, তাকে রাসায়নিক বিচূর্ণীভবন বলে।
পানি রাসায়নিক বিচূর্ণীভবনের প্রধান ভূমিকা নেয়। অনেক সময় গাছপালা ও প্রাণী শিলার বিয়োজনের সাহায্যে করে। মাটিতে থাকা লতাপাতা, ডালপালা ও মরা জীবজন্তুর অবশিষ্টাংশ পানি ও উত্তাপে বিয়োজিত হয় যা জৈব এসিড সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এই জৈব এসিডের বিক্রিয়ায় শিলা ক্ষয় হয়। রাসায়নিক বিচূর্ণীভবন ঘটাতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান দুটো হলঃ পানি ও উষ্ণতা। উষ্ণতা বেশি হলে রাসায়নিক প্রক্রিয়া জোরদার হয়। অনেক সময় দ্রবীভূত এসিড বা অক্সিজেন ও রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে। বিচূর্ণভবনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া প্রধানত তিনটি উপায়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। যথা-
(I) জারন (Oxidation)
(II) অঙ্গারন (Carbonation) এবং
(III) পানিযোজন (Hydration)
(I) জারন (Oxidation)
খনিজের সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন যুক্ত হলে তাকে অক্সিডেশন বা জারণ বলে। অক্সিডেশনে অক্সিজেনের ভূমিকায় মুখ্য। ভূপৃষ্ঠের পানি, বৃষ্টির জলে অক্সিজেন দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। শিলা খনিজের সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বেশি অক্সিজেন মিশলেই অক্সিডেশন ঘটে। পানি ও অক্সিজেন বিভিন্ন খনিজের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে না, কিন্তু লোহার ওপর অক্সিডেশন বিক্রিয়াটি সহজেই হয়। এই জন্য লোহায় সহজে মরিচা ধরে। আদ্র অঞ্চলে ও ভেজা লোহায় খুব সহজে মরিচা ধরে, কিন্তু শুষ্ক অঞ্চলে লোহায় তাড়াতাড়ি মরিচা পরে না। শিলাস্থিত অক্সিজেনের সাথে রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে ধাতব অগাইট উৎপন্ন হয়। এসব পরিবর্তনের শিলার বিচূর্ণভবন সংঘটিত হয়।
(II) অঙ্গারন (Carbonation)
শিলার সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের মিশ্রণ প্রক্রিয়াকেই অঙ্গারণ বলে। পানির সাথে এই গ্যাস মিশে গেলে কার্বলিক এসিড সৃষ্টি হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড মেশানো পানিতে চুনাপাথর সম্পূর্ণরূপে দ্রবীভূত হয়। এর ফলে পানির দ্রবণ ক্ষমতা কমে যায়। এরূপ পানিতে কঠিন পানি বলে।
যেসব শিলার মধ্যে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম এবং লৌহ থাকে, সেগুলির কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে এসে গলতে শুরু করে, ফলে শিলা বিচূর্ণভুত হয়।
দ্রবীভূত চুনাপাথর বিশিষ্ট পানি সমুদ্রে পড়লে জলজ প্রাণীগুলি তা থেকে চুন উপাদান বা ক্যালসিয়াম সংগ্রহ করে। এই উপাদান থেকেই জলজ প্রাণীর কঠিন বহিরাবরণ বা শেল সৃষ্টি হয়।
আর্দ্র অঞ্চলে ভূত্বকের চুনাপাথর দ্রুত দ্রবীভূত হয়। এর ফলে পর্বতের গায়ে এবং ভূ-নিম্নে বিশালাকার গুহার সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ চুনাপাথরের কিছু বালুকা বা কর্দম মিশানো থাকে। চুনাপাথর গলে গলে এগুলির অপরিবর্তিত অবস্থায় পড়ে থাকে। পৃথিবীর বহু চুনাপাথর অঞ্চলের গভীর উর্বর মাটি অঙ্গারায়ণ প্রক্রিয়ায় বিচুন্নিভবনের ফলেই সৃষ্টি লাভ করেছে।
(III) পানিযোজন (Hydration)
শিলার সাথে পানি মিশে গেলে তার ফলে যে রাসায়নিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়, তাকে পানিযোজন বলে। প্রচুর পানি ও উত্তাপ রাসায়নিক ক্রিয়ার অনুকূল অবস্থা; এজন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিশিষ্ট অঞ্চলে রাসায়নিক ক্ষয়ক্রিয়া সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক বৃষ্টি বা স্রোতের পানিতে প্রচুর অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও নানাবিদ অম্ল উপাদান মিশানো থাকে। বিশুদ্ধ পানির দ্রবণ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হলে অনুরূপ উপাদান সমৃদ্ধ পানি ভূত্বককে প্রভূত পরিমানে বিচূর্ণভবন ঘটায়। চুনাপাথর উপাদান সমৃদ্ধ এলাকায় পানি যোজনের ফলাফল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৩। জৈবিক বিচূর্ণী ভবন (Biological Weathering)
মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতাদি প্রতিনিয়ত ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় ও পরিবর্তন সাধন করছে।এর মধ্যে মানুষের করা ক্ষয়ক্রিয়া সহজে দৃষ্টি গোচর হয়। কিন্তু কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু বা উদ্ভিদ দ্বারা যেসব ক্ষয়কার্য সাধিত হচ্ছে তা সহজে বুঝা যায় না; অথচ এই ক্ষয়ক্রিয়ার ফলাফল বহু ব্যাপক। জৈবিক বিচূর্ণীভবনকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা-
১। উদ্ভিদের কাজ (Works of plant)
২। প্রাণীর কাজ (Works of animals and insects) এবং
৩। মানুষের কাজ (Works of Man) ।
১। উদ্ভিদের কাজ (Works of plant)
উদ্ভিদ প্রতিনিয়ত ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় সাধন করছে। পর্বতের বা সমতল ভূমির শিলার ফাটলের মধ্যে উদ্ভিদের মূল প্রবেশ করে নিচে বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এই মূল বা শিকড় ক্রমশঃ মোটা ও দীর্ঘ হয়। এর ফলে উদ্ভিদের মূল কিলকের মত চাপ দেয় বলে শিলাস্তর ফেটে যায়। এবং ক্রমশঃ আয়তনে বেড়ে যায়। ফলে কালক্রমে শিলাগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। মাটি আলগা হলে তার মধ্যে সহজেই বৃষ্টির পানি প্রবেশ করে ক্ষয় সাধন করে। বনভূমিতে বড় বড় গাছের শিকড় দ্বারা মাটির যে ফাটলের সৃষ্টি হয়, তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানি, সঞ্চিত তুষার প্রভৃতি দ্বারা ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন সাধিত হয়। অনেক সময় শিলার উপর শ্যাওলা জন্মে। এ শ্যাওলা থেকে এক প্রকার এসিড বের হয়ে রাসায়নিক উপায়ে শিলার ক্ষয়সাধন করে।
২। প্রাণীর কাজ (Works of animals and insects)
উদ্ভিদ অপেক্ষা জীবজন্তু ও পোকামাকড় দ্বারা ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় সাধন আরও দ্রুত হয়ে থাকে। কিন্তু জীবজন্তু বা কীট পতঙ্গের দ্বারা সাধিত পরিবর্তন অতি সূক্ষ্ম বলে তা সহজে বুঝতে পারা যায় না। বিভিন্ন প্রকার জীবজন্তুর মধ্যে পিপড়া, কেঁচো, সুচো, কুকুর, শুকর, বিবর প্রভৃতি প্রাণী মাটি খুঁড়ে ওলট-পালট করে। উইপোকা মাটির ঢিবি তৈরি করে, ইঁদুর গর্ত করে অব্যান্তর থেকে উপরে মাটি তোলে, সজারু সমভূমিতে ও পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে বাস করে। এরূপে বিভিন্ন জীবজন্তু ও কিট পতঙ্গ অহরহ ভূত্বকের পরিবর্তন সাধন করছে। এদের মধ্যে কেঁচোই জমিকে বিশেষ উর্বর করে তোলে।
৩। মানুষের কাজ (Works of Man)
বর্তমান যুগে মানুষ তাদের সুবিধার জন্য বিবিধ পরিকল্পনার মাধ্যমে রাস্তাঘাট তৈরি করে, দীর্ঘ খাল খনন করে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে, বিরাট বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি আটক করে, কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি করে, সমুদ্র থেকে স্থল ভাগের উদ্ধার সাধন করে, পানি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা কার্যকরী করে, মূল্যবান ধাতুর সংগ্রহের জন্য গভীর খনি খনন করে, শহর-বন্দর-গৃহাদী নির্মাণ করে প্রতিনিয়ত ভূত্বকের নানাবিধ পরিবর্তন সাধন করছে।
মন্তব্য,
আজকের এই প্রতিবেদনে বিচূর্ণীভবন বলতে কি বুঝ বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়া সমূহ আলোচনা বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেছি। আমি আশা করছি এ বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। উপস্থাপিত তথ্য নির্ভরযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের বই অনুসরণ করা হয়েছে যাতে উপস্থাপিত তথ্য নির্ভুল ও সাবলীল হয়। এ বিষয়ে যদি আপনার কোন মন্তব্য থাকে তবে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এই ওয়েবসাইটের এডমিন সমস্ত কমান্ডের জবাব প্রদান করে থাকে। প্রতিবেদনটি মনোযোগের সহিত পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url