পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং গঠনকারী উপাদান

প্রিয় পাঠক, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং গঠনকারী উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে খুব আগ্রহী, বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করেও মনের মত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক ও ঘাটাঘাটি অব্যাহত রয়েছে? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি প্রান্ত প্রয়োজন।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং গঠনকারী উপাদান

আজকের এই প্রতিবেদনে ভূ-অভ্যন্তরের গঠন, অশ্বমন্ডল গুরুমন্ডল কেন্দ্রমন্ডল এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং গঠনকারী উপাদান সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মনোযোগের সহিত পড়তে থাকুন বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ভূমিকা

ভূ-অভ্যন্তর সম্পর্কে জানার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভু-অভ্যন্তর নিয়ে গবেষণা করাটা ভূগোলবিদের কাজের আওতায় না পড়লেও এর প্রাথমিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরী। কারণ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন ভূমিরূপ অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রকৃতি, পদ্ধতি ও চৌম্বকত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন সম্পর্কের জানতে হলে ভু-ভান্তরের প্রায় ৬৪০০ কিলোমিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু প্রচণ্ড তাপ, চাপ এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অভাবে মানুষের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ভূতত্ত্ববিদগণ এখন পর্যন্ত ভু-অভ্যন্তরের মাত্র ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত গবেষণা করতে সক্ষম হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে উৎক্ষিপ্ত লাভা গভীর খনি এবং উল্কাপিণ্ড থেকে ভূ-অভ্যন্তর সম্পর্কে কিছু জ্ঞান অর্জন করা যায়।

ভূ-অভ্যন্তরের গঠন এবং উপাদান (Internal Structure of the Earth and Elements)

সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী একটা চলন্ত বাষ্পপিণ্ড ছিল। বিভিন্ন ধাতব ও অধাতব পদার্থ, গ্যাস, জলীয় বাষ্প দিয়ে ভরপুর ছিল। পরবর্তীকালে বহু বছর ধরে তাপ বিকিরণ ও নানা পরিবর্তন এবং বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর আজকের এই অবস্থানে এসেছে। এই বিবর্তন ও পরিবর্তনের মাধ্যমেই পৃথিবীর মধ্যকার ভারি পদার্থগুলো যেমন-নিকেল, লৌহ এগুলো কেন্দ্রের দিকে সঞ্চিত হয় এবং হালকা উপাদান গুলো যেমন-সিলিকন ও অ্যালুমিনিয়াম উপরের দিকে উঠে আসে যা পৃথিবীর উপরিভাগে কঠিন আবরণ তৈরি করে। পৃথিবীর এই কঠিন অপরিভাগ 'অশ্বমণ্ডল' নামে পরিচিত। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য ও ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভূত্বক পর্যন্ত অংশকে বিজ্ঞানীগণ তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১। কেন্দ্রমন্ডল (Centrosphere)
২। গুরুমন্ডল (Barysphere) ও
৩। অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল (Lithosphere)।

১। কেন্দ্রমন্ডল (Centrosphere)

পৃথিবীর অভ্যন্তরের কেন্দ্রস্থ অঞ্চল অর্থাৎ গুরুমন্ডলের নিম্নভাগ থেকে কেন্দ্রভাগ পর্যন্ত চারিদিকে প্রায় ৩৪৮৬ কিলোমিটার বিস্তৃত এক গোলক অবস্থিত যা কেন্দ্র মন্ডল নামে পরিচিত। মূলত গুরুমন্ডলের নিচেই এই মন্ডলের অবস্থান। এই স্তরের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১০ থেকে ১৩.৬। কেন্দ্রমন্ডলের ঘনত্বের চাপ নিচের অংশে ৩৭০০ কিলোবার, ওপরের অংশে ৩৩৪০ কিলোবার, গড় চাপের পরিমাণ প্রায় ৩৬৮০ কিলোবার। কেন্দ্রমন্ডলের তাপমাত্রা স্থানভেদে ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৫০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি।

কেন্দ্রমন্ডল লৌহ, নিকেল, পারদ, সিসা প্রভৃতি ভারি ও কঠিন পদার্থ দ্বারা গঠিত। এই উপাদান গুলোর মধ্যে নিকেল এবং লৌহের পরিমাণ অধিক বলে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ভূ-বিজ্ঞানী Suess এর নাম দেন নিফে এবং প্রফেসর হোমস এর নাম দেন অন্তঃস্তর। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন কেন্দ্রমন্ডলের প্রচন্ড তাপ ও চাপে এর উপাদান গুলো সম্পন্ন কঠিন অবস্থায় নেই, এর কাঠামো স্থিতিস্থাপক ও চটচটে অবস্থায় আছে বলে ধারণা পোষণ করা হয়। ভূকম্পন তরঙ্গের মাধ্যমে বোঝা যায় কেন্দ্রমন্ডল দুইটি অংশে বিভক্ত। যথা-
(I) অন্তঃকেন্দ্র (Inner Core)
(II) বহিঃকেন্দ্র (Outer Core)

(I) অন্তঃকেন্দ্র (Inner Core)

পৃথিবীর কেন্দ্র হতে প্রায় ১২১৬ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে এই অংশটি কঠিন অবস্থায় রয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্রমন্ডলের গভীরতা ৫১৫৫ কিলোমিটার হতে ৬৩৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভূমিকম্পের P ও S তরঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, S তরঙ্গ কেন্দ্রমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে না কিন্তু P তরঙ্গ বহিঃকেন্দ্রের তুলনায় অন্তঃকেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা মতে, এই কেন্দ্রমন্ডলের কঠিন অবস্থা নির্দেশ করে।

(II) বহিঃকেন্দ্র (Outer Core)

কেন্দ্রমন্ডলের বাইরের অংশের বিস্তৃতি ২২৭০ কিলোমিটার অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে এই অংশটি ২৮৮৫ কিলোমিটার থেকে ৫১৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সাধারণত ভূকম্পন তরঙ্গ গুলো যত ঘনত্ব স্তর দিয়ে প্রবাহিত হয় এর গতিবেগ কত বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিকম্পের S তরঙ্গ তরল পদার্থের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে পারে না। তাই বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বহিঃকেন্দ্র তরল অবস্থায় রয়েছে এবং এখানে তরল লোহা ও নিকেল উপাদানগুলো যথেষ্ট ঘনীভূত অবস্থায় রয়েছে।

২। গুরুমন্ডল (Barysphere)

ভূত্বকের নিম্নভাগ থেকে কেন্দ্রমন্ডলের বহিঃভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরকে গুরুমন্ডল বলে। এই স্তরটি প্রায় ২৮৮৫ কিলোমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত। এই স্তরের উপাদানগুলোর মধ্যে শিলিকা এবং ম্যাগনেসিয়াম এর প্রাধান্যের কারণে ও বিজ্ঞানী Suess এই স্তরকে নামকরণ করেন সীমা। এছাড়া এখানে লৌহ, কার্বন প্রভৃতি উপাদানও রয়েছে। গুরুমন্ডলের তাপমাত্রা ১১০০ ডিগ্রি - ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বিরাজ করে। গুরুমন্ডলের উপরের অংশে ঘনত্বের চাপ ২৬০ কিলোবার এবং নিচের অংশে ঘনত্বের চাপ ১৩৫০ কিলোবার। গুরুমন্ডলকে ও দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(I) আন্তঃগুরুমন্ডল (Lower Mantle) ও
(II) বহিঃগুরুমন্ডল (Upper Mantle)

(I) আন্তঃগুরুমন্ডল (Lower Mantle)

এই মন্ডলটি ৭০০ কিলোমিটার থেকে ২৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। গুরুমন্ডলের এই স্তরের লৌহ, নিকেল, সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম এর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তাই একে (Nifesima) নিফেসীমা নামেও অভিহিত করা হয়। গুরুমন্ডলের ৭০০ কিলোমিটার গভীরতায় তাপমাত্রা ১৯০০ ডিগ্রি থেকে ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই অংশের ঘনত্ব প্রায় ৫.৫। আন্তঃগুরুমন্ডল থেকে উপরের দিকে অর্থাৎ বহিঃগুরুমন্ডলে ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে।

(II) বহিঃগুরুমন্ডল (Upper Mantle)

গুরুমন্ডলের উর্ধাংশে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত অংশ ঊর্ধ্ব গুরুমন্ডল নামে পরিচিত। অর্থাৎ যে অংশটি ভূত্বকের সাথে যুক্ত হয়েছে তা হলো বহিঃগুরুমন্ডল। এ অংশের উপাদান গুলোর মধ্যে ক্রমিয়ম, লৌহ, সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম এর প্রাচুর্য দেখা যায়, তাই এটি (Crofesima) ক্রফেশীমা নামেও পরিচিত। গুরুমন্ডলের ১০০ কিলোমিটার গভীরতায় তাপমাত্রা ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৭০০ কিলোমিটার গভীরতায় তাপমাত্রা প্রায় ১৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

৩। অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল (Lithosphere)

গুরমন্ডলের উপরের স্তরটির নাম হচ্ছে অশ্বমন্ডল। এটি সবচেয়ে উপরের অংশ। 'Lithos' শব্দের অর্থ শিলা, এটি গ্রানাইট জাতীয় শিলার মিশ্রণে গঠিত বলে একে শিলামন্ডল ও বলা হয়। ভূত্বক হতে গুরুমন্ডলের বহিঃসীমানা পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার পুরু স্তরকে শিলামন্ডল বা অশ্বমন্ডল বলে। যদিও ভূত্বকের গড় পুরুত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। অশ্বমন্ডল সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, কোয়ার্টজ, ফেল্ডসপার প্রভৃতি উপাদানে গঠিত। তবে মূল উপাদান হলো সিলিকন ও অ্যালুমিনিয়াম। এজন্য ভূ-বিজ্ঞানী Suess এই স্তরকে নাম দেন "সিয়াল"। যে স্তরের গড় ঘনত্ব ২.৯১ অশ্ব মন্ডলের ঘনত্বের চাপ প্রায় ৯ কিলোবার। অশ্বমন্ডলের নিচের দিকে প্রতি কিলোমিটার এ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। অশ্ব মন্ডলের আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৭ থেকে ৩, অর্থাৎ পানি থেকে প্রায় তিনগুণ ভারি।

মন্তব্য,

আজকের এই প্রতিবেদনে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং গঠনকারী উপাদান সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি আশা করছি এই বিষয়ে পুরোপুরি ধারণা পেয়েছেন। সঠিক তথ্য উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের বই-পুস্তক অনুসরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার যদি কোন মন্তব্য থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
2 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • Anonymous
    Anonymous August 10, 2024 at 12:28 PM

    রেফারেন্স কই?

  • Anonymous
    Anonymous September 12, 2024 at 9:08 AM

    অশ্মমণ্ডল হবে।
    অশ্বমণ্ডল নয়।

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url