রূপান্তরিত শিলা, এর বৈশিষ্ট্য এবং রূপান্তরিত শিলার শ্রেণীবিভাগ

প্রিয় পাঠক, রূপান্তরিত শিলা এর বৈশিষ্ট্য এবং রূপান্তরিত শিলার শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, এই বিষয়ে জানার জন্য বিভিন্ন পেপার, পুস্তক ও ওয়েবসাইট ঘাটাঘাঁটি করছেন? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। কারণ এই প্রতিবেদনটি আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন নির্ভরযোগ্য তথ্য জানতে পারবেন।

রূপান্তরিত শিলা, এর বৈশিষ্ট্য এবং রূপান্তরিত শিলার শ্রেণীবিভাগ

আমার আজকের এই প্রতিবেদনে শিলা কাকে বলে? শিলার শ্রেণীবিভাগ, রূপান্তরিত শিলা কাকে বলে? রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য, কতিপায় রূপান্তরিত শিলার বর্ণনা এবং রূপান্তরিত শিলার শ্রেণীবিভাগ সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওনির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন আপনার কাঙ্খিত চাহিদা পূরণ হবে।

ভূমিকা

প্রাকৃতিক উপায়ে কতগুলি মৌলিক উপাদান পরস্পর মিলিত হয়ে যে যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি করে তাকে খনিজ (Mineral) বলে। দুই বা ততোধিক খনিজ প্রাকৃতিক উপায়ে একত্রিত হয়ে যে পদার্থ গঠন করে তাকে শিলা (Rock) বলে। শিলা বলতে কেবল কঠিন পদার্থকেই বোঝায় না- নুড়ি, কাকর, পাথর, বালি, মাটি, কাদা প্রভৃতি শিলার অন্তর্ভুক্ত। ভূ-ত্বক বিভিন্ন প্রকার শিলার সমন্বয়ে গঠিত। ভূ বিজ্ঞানীরা শিলা গুলির খনিজ উপাদান অনুসন্ধান করেন এবং শিলার বৈশিষ্ট্য থেকে যে পরিবেশে সেগুলি উৎপত্তি হয়েছিল সেই পরিবেশ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করেন। জানা গেছে আমাদের এই পৃথিবী গলিত লৌহ, ঘনবদ্ধ শিলা, গ্রানাইট, পাললিক শিলা, সুমুদ্র প্রভৃতি সমন্বয়ে গঠিত।

শিলার শ্রেণীবিভাগ (Classification of Rocks)

ভূ-পৃষ্ঠে শিলাগুলির পরস্পরের মধ্যে গঠন, কাঠামো, গঠনকারী খনিজের আকৃতি, আয়তন, কাঠিন্য ও ভাঙ্গন পদ্ধতি ইত্যাদির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যামান। ফলে সেগুলি সহজে সনাক্ত করা যায়। উৎপত্তি ও গঠন প্রণালী অনুসারে শিলারাশি কে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও রূপান্তরিত শিলা নামক তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।

রূপান্তরিত শিলার চিত্র

রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rocks)

আগ্নেয় শিলা ও পাললিক শিলা অত্যাধিক চাপ ও প্রচন্ড তাপের প্রভাবে অথবা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নতুন রূপ লাভ করলে তাকে রূপান্তরিত শিলা বলে। শিলার পরিবর্তন যান্ত্রিক বা রাসায়নিক বা উভয় প্রকার ই হতে পারে। একটি খনিজ অন্য খনিজে পরিবর্তিত হতে পারে, খনিজের দানাগুলি পরিবর্তিত হতে পারে, অধিক উত্তাপে দ্রবীভূত হতে পারে বা অন্য কোন নতুন পদার্থ এর সাথে মিশতে পারে।

রূপান্তরিত শিলার ছবি

রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Metamorphic Rocks)

আগ্নেয় ও পাললিক শিলার মত রূপান্তরিত শিলার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে এই বৈশিষ্ট্য গুলি সম্বন্ধে আলোকপাত করা হলো-

১। কাঠিন্যতা

তাপ ও চাপের প্রভাবে আগ্নেয় শিলা ও পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় বলে এই শিলার কাঠিন্যতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এজন্য অন্যান্য শিলা অপেক্ষা রূপান্তরিত শিলা অনেক বেশি শক্ত ও মজবুত।

২। কেলাসিত

তাপ ও চাপের প্রভাবে আগ্নেয় শিলা ও পাললিক শিলা পরবর্তীতে হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় বলে এই শিলা সাধারণত কেলাসিত হয়।

৩। সমান্তরাল গঠন

রূপান্তরিত শিলার উপাদানগুলি সাধারণত সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। এই অবস্থান আনুভূমিক, তীর্যক বা বক্র যেকোনো প্রকার হতে পারে।

৪। জীবাশ্ম বিহীনতা

আগ্নেয় শিলা থেকে রূপান্তর হলে তার মধ্যে জীবাশ্ম থাকতে পারে না। আবার পাললিক শিলা অত্যাধিক চাপ ও তাপের প্রভাবে রূপান্তরিত হবার সময় এর মধ্যস্থিত জীবাশ্ম নষ্ট হয়। এইজন্য রূপান্তরিত শিলা জীবাশ্ম বিহীন।

৫। তরঙ্গ চিহ্ন বিহীনতা

চাপ ও তাপের প্রভাবে রূপান্তরিত হবার সময় পাললিক শিলার তরঙ্গ চিহ্নগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য রূপান্তরিত শিলার কোন প্রকার তরঙ্গ চিহ্ন দেখা যায় না।

কতিপয় রূপান্তরিত পাললিক শিলা

নিম্নে কতিপয় রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য সহ বিবরণ উল্লেখ করা হলো-

রূপান্তরিত শিলার পিকচার

১। মার্বেল (Marble)

চুনাপাথর রূপান্তরিত হয়ে মার্বেল বা মর্মর পাথরে পরিণত হয়। কালসাইট এর প্রধান খনিজ উপাদান। এই শিলার মধ্যে কোন স্তর বিন্যাস নেই। কেলাসিত হওয়ার ফলে শিলাটি যথেষ্ট মসৃণ। মার্বেল সাধারণত সাদা তবে রূপান্তরিত হবার সময় এর সাথে লাল সবুজ কালো ধূসর প্রভৃতি রং সংযোজিত হয় বলে বিভিন্ন বর্ণের মার্বেল দেখতে পাওয়া যায়।

২। কোয়ার্টজাইট (Quartzite)

বেলে পাথর ও গ্রিট রূপান্তর হয়ে কোয়ার্টজাইট এ পরিণত হয়। কোয়ার্টজা এর মূল খনিজ উপাদান। রূপান্তরিত হবার সময় তাপ ও চাপের প্রভাবে, দ্রবণের অবক্ষেপণ ও সিলিকার উপস্থিতির ফলে আদি শিলার দানাগুলির মধ্যবর্তী ফাঁক সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হয়। ফলে মসৃণ ও চকচকে এই শিলাটি বিভিন্ন শিলার মধ্যে সবচেয়ে টেকসই।

৩। শ্লেট (Slate)

কর্দম, কর্দমপাথর ও শেল রূপান্তরিত হয়ে শ্লেট পাথরে পরিণত হয়। রূপান্তরিত হবার সময় অন্যান্য মিহি উপাদান এর সাথে মিশে যায়। আগত বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অভ্রকণা উল্লেখযোগ্য। শ্লেট এর কোনাগুলি সূক্ষ্ম ও মসৃণ এবং ভাঙ্গলে পাতলা ফলকগুলি আলাদা হয়। অধিকাংশ শ্লেট নীলাভ কৃষ্ণ বর্ণ বিশিষ্ট। এছাড়া ধূসর, সবুজ ও লাল বর্ণের শ্লেট পাওয়া যায়।

৪। ফাইলাইট (Phylite)

শেল ও সুক্ষ কণা বিশিষ্ট মৃত্তিকা রূপান্তরিত হয়ে ফাইলাইট শিলায় পরিণত হয়। অধিক চাপে শ্লেট ক্রমে ফাইলাইট ও পরে সিস্টে সৃষ্টি রূপান্তরিত হয়। ইহা বিভিন্ন বর্ণের হয়। এই শিলার উদাহরণ যথেষ্ট স্পষ্ট।

রূপান্তরিত শিলার ছবি

৫। সিস্ট (Schist)

ফাইলাইট, ডলোমাইট, সেল, শ্লেট প্রভৃতি শিলা রূপান্তর হয়ে সিস্ট শিলাই পরিণত হয়। কাদা, পাথর, রূপান্তরিত হয়ে প্রথমে শ্লেট ও পরে সিস্ট শিলাই পরিণত হয়। এর খনিজ উপাদান গুলির মধ্যে ফেলসপার,কোয়ার্টজ ও অভ্র প্রধান। সিস্ট সুষ্ঠ স্তরে বিন্যস্ত দানাদার শিলা। এর বর্ণনা নাবিদধ।

৬। নিস (Gneiss)

বিভিন্ন শিলা রূপান্তরিত হয়ে নিস শিলাই পরিণত হয়। এগুলির মধ্যে গ্রানাইট, কংগ্লোমারেট, ডাইওরাইট ও বেলেপাথর প্রধান। নিসের খনিজ উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে ফেলসপার, কোয়ার্টজ ও অভ্র। এই শিলার কোনগুলি সূক্ষ্ম নয় এবং এগুলি সমান্তরাল স্তরে সুসজ্জিত থাকে।

৭। ল্যাটেরাইট (Laterite)

লৌহ, অ্যালুমিনিয়াম, অক্সাইড ও হাইড্রোক্সাইড খনিজ সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় এই শিলা ইটের মতো লাল বর্ণের দেখায়। কখনো কখনো গাঢ় হলুদ বর্ণের ও হয়। উষ্ণ, আদ্র জলবায়ুতে এই শিলার সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

রূপান্তরিত শিলার শ্রেণীবিভাগ (Types of Metamorphic Rocks)

শিলার উৎসের উপর নির্ভর করে রূপান্তরিত শিলা কে দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল-
(ক) আগ্নেয়-রূপান্তরিত শিলা এবং
(খ) পাললিক-রূপান্তরিত শিলা

(ক) আগ্নেয়-রূপান্তরিত শিলা

অধিক চাপও প্রচন্ড তাপের প্রভাবে বা উভয় শক্তির প্রভাবে আগ্নেয়শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হলে তাকে আগ্নেয়-রূপান্তরিত শিলা বলে। তাপ-যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে 'গ্রানাইট' নামক আগ্নেয় শিলা 'নীস' শিলায় এবং 'অগাইট' নামক আগ্নেয়শিলা 'হর্নব্লেন্ডে' পরিণত হয়।

(খ) পাললিক-রূপান্তরিত শিলা

অধিক চাপ ও তাপের প্রভাবে বা উভয় শক্তি প্রভাবে পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হলে তাকে পাললিক-রূপান্তরিত শিলা বলে। মূল উপাদানের ওপর ভিত্তি করে পাললিক-রূপান্তরিত শিলা গুলিকে চুনাময়, অঙ্গারময়, বালুকাময়, কর্দমময় নামক চার ভাগে বিভক্ত করা হয়।

১। চুনাময় (Calcareous)

চুনা বিশিষ্ট পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে যখন রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় তখন সে শীলাকে চুনাময় রূপান্তরিত শিলা বলে। সাধারণতঃ তা বা স্পর্শ জনিত কারণে আঞ্চলিক আকারে এরূপ রূপান্তর সাধিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় 'চুনাপাথর' রূপান্তরিত হয়ে 'মার্বেল' পাথরে পরিণত হয়।

২। অঙ্গারময় (Carbonaceous)

অঙ্গারময় পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপান্তরিত শিলা সৃষ্টি করে তাকে অঙ্গারময় রূপান্তরিত শিলা বলে। সাধারনতঃ স্থানীয় রূপান্তরের মাধ্যমে এরূপ শিলার উদ্ভব হয়। তাপ ও চাপের প্রভাবে 'কয়লা' রূপান্তরিত হয়ে 'গ্রাফাইটে' পরিণত হয়।

৩। বালুকাময় (Arenaceous)

বালুকাময় পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপান্তরিত শিলার সৃষ্টি করে তাকে বালুকাময় রূপান্তরিত পাললিক শিলা বলে। সাধারণতঃ তাপ রূপান্তর বা স্পর্শ রূপান্তরের মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে এরূপ রূপান্তর সাধিত হয়। বেলেপাথর ও গ্রিট তাপ ও স্পর্শ রূপান্তরের মাধ্যমে কোয়াটজাইট পাথরে পরিণত হয়।

৪। কর্দমময় (Argillaceous)

কর্দমময় পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় তাকে কর্দমময় রূপান্তরিত পাললিক শিলা বলে। সাধারণতঃ আঞ্চলিক রূপান্তরের মাধ্যমে এ জাতীয় শিলার উদ্ভব হয়।কর্দম, কর্দম পাথর শেল প্রভৃতির তাপ ও চাপের প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে শ্লেট ও সিস্ট শিলাই পরিণত হয়।

মন্তব্য

আজকের প্রতিবেদনে শিলা কাকে বলে, শিলার শ্রেণীবিভাগ, রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য ও কতিপয় রূপান্তরিত শিলার বর্ণনা সহ বেশ কিছু তথ্য আলোচনা করা হয়েছে, আশা করছি এই বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। এই প্রতিবেদনটি তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের পুস্তক অনুসরণ করা হয়েছে। এর প্রতিবেদন সংক্রান্ত কোনো মতামত থাকলে কমেন্টস বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এই ওয়েবসাইটের এডমিন প্রতিটা কমেন্টসের মূল্যায়ন করে থাকে। আপনাকে ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url