পানিবাহিত রোগ,পানিবাহিত রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সম্মানিত পাঠক, আপনি কি পানিবাহিত রোগ কোনগুলো, পানিবাহিত রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, পানি বাহিত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা গুলো কি, এ সমস্ত বিষয়গুলো জানতে চাচ্ছেন, তাহলে আপনার জন্য আজকের এই প্রতিবেদনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রতিবেদনে পানিবাহিত রোগ কোনগুলো, এ রোগের লক্ষণ, এর রোগ হলে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই রোগ থেকে দূরে থাকা যায়, এগুলো সহ পানি বাহিত রোগ সম্পর্কিত আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে চলুন আমরা এগুলো দেখে নিই-
ভূমিকাঃ
সুস্থ থাকতে হলে আমাদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, সুষম পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা এবং স্বাস্থ্যকর নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। কিন্তু এরপরও আমরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে নানা রকম রোগে আক্রান্ত হই। এর প্রধান কারণ হলো, আমরা অসংখ্য রোগ জীবাণুর মধ্যে বাস করি।
আমাদের চারপাশে এত অসংখ্য রোগ জীবাণুর কোনটাই আমরা দেখতে পাই না, কারণ অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে এগুলো খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এগুলো দেখার জন্য মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়।
আমরা অনেকেই জানি যে হাম, জল বসন্ত, ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি রোগ কোন এলাকায় শুরু হলে তা খুব দ্রুত মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। কারণ এসব রোগ একজনের শরীর থেকে অন্য জনের শরীরে সহজে ছড়িয়ে যায়। তাই এগুলোকে সোয়াছে বা সংক্রামক রোগ বলে। এদের মধ্যে পানি বাহিত রোগ অন্যতম।
পানি বাহিত রোগ
যেসব রোগ জীবাণু পানির মাধ্যমে ছড়ায় সেসব রোগকে পানি বাহিত রোগ বলে। যেমন ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস বা জন্ডিস, টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি। নিম্নের পানি বাহিত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
১। ডায়রিয়া,
২। কলেরা,৩। আমাশয়,
৪। জন্ডিস ও
৫।টাইফয়েড ইত্যাদি।
১। ডায়রিয়াঃ
ডায়রিয়া একটি অন্যতম পানিবাহিত রোগ। এ রোগের আক্রমণে প্রতি বছর অনেক শিশু, এমনকি বয়স্ক মানুষও মারা যায়। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা এই রোগে বেশি মারা যায়। কারো যদি দিনে তিনবার পাতলা পায়খানা হয় তাহলে তার ডায়রিয়া হয়েছে বলে মনে করা হবে।
ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া হলে রোগীর শরীর থেকে পানি ও কয়েক রকম লবণ বেরিয়ে যায়। ফলে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে একে বলে পানি স্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন। দ্রুত এর চিকিৎসা না নিলে রোগী একসময় মারা যায়।
ডায়রিয়ার লক্ষণঃ
ডায়রিয়া লক্ষণ গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-
- ঘনঘন পাতলা পায়খানা হয়।
- বারবার বমি হয়।
- খুব পিপাসা লাগে, মুখ ও শুকিয়ে যায়।
- চোখ বসে যায়।
- শিশুর মাথা চাঁদি বা তালু বসে যায়।
- আস্তে আস্তে রোগীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
ডায়রিয়ার চিকিৎসাঃ
ডায়রিয়া হলে দ্রুত যে চিকিৎসা গুলো করা দরকার সেগুলো হলো-
- ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে রোগীকে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
- খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর পাশাপাশি রোগীকে তার উপযোগী স্বাভাবিক খাবার, বিশেষ করে তরল খাবার, যেমন ভাতের মাড়, যাও, সুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
- শিশুকে বারবার মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
- পাতলা পায়খানা বা বমি না কমলে, পানি স্বল্পতা না কমলে বা রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকলে, নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডায়রিয়ার প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থাঃ
পানি বাহিত রোগ ডায়রিয়া হলে কি কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, এগুলো একটু দেখে নিন
- সবসময় নিরাপদ পানি পান করতে হবে।
- থালা-বাসন সব সময়ই পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুতে হবে।
- পায়খানার পর দুই হাত ভালো হবে সাবান দিয়ে ধুতে হবে।
- পচা,বাসী, খোলা বা মাছি বসা খাবার কখনোই খাওয়া যাবে না।
- খাওয়ার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে দুই হাত ধুয়ে নিতে হবে।
- কাচা সবজি বা সালাদ খাওয়ার আগে এগুলো ভালো করে নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
- মুখে বা দাঁতে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচানো যাবে না।
- দাঁত দিয়ে নখ কাটা যাবে না।
- কাগজ বা টাকা গণনার সময় জিহবা থেকে আঙ্গুল ভিজিয়ে নেওয়া যাবে না।
- বই খাতা পেন্সিল কলম ইত্যাদি মুখে নেওয়া যাবে না বা কামড়ানো যাবে না।
- ছোট বাচ্চারা যাতে খেলনা মুখে পুরে না ফেলে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
২। কলেরাঃ
ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ার মতই কলেরা একটি পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ। Vibrio cholerac জীবাণুর সংক্রমনের ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। এই রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সমূহ ডায়রিয়ার মতই। এই রোগে পাতলা পায়খানার সাথে রোগী বমিও করে থাকে।
উপযুক্ত চিকিৎসা, প্রচুর খাওয়ার স্যালাইন, প্রয়োজন হলে শিরায় স্যালাইন, ইনজেকশন এবং প্রচুর তরল খাবার দিয়ে রোগের পানি স্বল্পতা পূরণের মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার করা সম্ভব।
৩। আমাশয়ঃ
আমাশয় একটি অতি পরিচিত রোগ। বহু লোক নিয়মিতভাবেই এই রোগে ভুগে থাকেন। দূষিত পানি ও নোংরা, পচাবাসী খাদ্যের মাধ্যমে এই রোগ জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে। সেখানে বংশবৃদ্ধির পর এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
আমাশয়ের লক্ষণঃ
আমাশয় হলে যে সমস্ত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো হল-
- সামান্য জ্বরের সাথে ঘন ঘন মলত্যাগ, আম মিশ্রিত থাকে।
- তলপেটে ব্যথা হয়।
- অনেক সময় স্লেসমা মিশ্রিত মলের সাথে রক্ত যায়।
আমাশায়ের প্রতিকার ও প্রতিরোধঃ
পানিবাহিত রোগ আমাশয় এর প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গুলো নিম্নরূপ
- এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে।
- নিরাপদ পানি পান করতে হবে।
- স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে।
- নোংরা, পচা,বাসী ও খোলা খাবার পরিহার করতে হবে।
- কাঁচা ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া ও রান্নার আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
- খাওয়ার আগে ও মলত্যাগের পর হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুতে হবে।
৪। জন্ডিসঃ
এটি একটি পানিবাহিত রোগ। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে বা অন্য কোন কারণে যকৃত বা লিভার কোষ ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে রক্তে পিত্তরসের পরিমাণ বিশেষত বিলিবিলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই অবস্থাকে জন্ডিস বলে।
জন্ডিসের লক্ষণঃ
জন্ডিসের লক্ষণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
- বমি বমি ভাব, শরীরের সামান্য জ্বর থাকতে পারে ও পরে আবার নাও থাকতে পারে।
- খাওয়ায় অরুচি, খাবারের গন্ধে বমি আসা।
- প্রসবের রং হলুদ হওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া এবং মলের রং সাদাটে হওয়া।
- মাথাব্যথা ও শীত শীত অনুভূত হওয়া।
- পেটের ডান দিকে যেখানে যকৃত থাকে সেখানে ব্যথা হওয়া।
- কয়েকদিন পর চোখের সাদা অংশ হলুদ রং ধারণ করা। পরে সারা শরীর ও নখ হলুদ দেখায়।
জন্ডিসের প্রতিকার ও প্রতিরোধঃ
পানি বাহিত রোগ জন্ডিস এর প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো
- সম্পূর্ণ বিশ্রাম এই রোগের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা।
- কম মসলা দিয়ে তরকারি রান্না করতে হবে।
- ডায়াবেটিস না থাকলে চিনির শরবত ও মিষ্টি জাতীয় জিনিস বেশি করে খেতে হবে।
- ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
- জন্ডিসের টিকা নিয়ে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে ক্লিক করুন- হাসি অনলাইন আইটি
৫। টাইফয়েডঃ
টাইফয়েড ও একটি পানিবাহিত সংক্রামক রোগ। গ্রামের চেয়ে শহরেই এই রোগটি বেশি হয়। নিম্নে এই রোগের লক্ষণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো-
টাইফয়েডের লক্ষণঃ
টাইফয়েড একটি পানিবাহিত মারাত্মক রোগ,এই রোগের লক্ষণ গুলো হল-
- জ্বর হয়, জ্বর কখনো সম্পন্ন ছাড়ে না, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
- জ্বরের সাথে মাথা ব্যথা ও ঘাম হয়।
- প্রথম দিকে কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, কয়েকদিন পর পেট ফাঁপা ও ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হতে থাকে।
টাইফয়েডের প্রতিকার ও প্রতিরোধঃ
টাইফয়েড রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গুলো নীচে উল্লেখ করা হলো-
- এই রোগে আক্রান্ত হলে যথাসম্ভব দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে ওষুধ ও পথ্য গ্রহণ করতে হবে, নইলে রোগীর অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকবে।
- মাথায় পানি দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- এই রোগ প্রতিরোধের জন্য ডায়রিয়া ও আমাশয়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে।
- বর্তমানে টাইফয়েডের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে যা দিয়ে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখকের মন্তব্যঃ
পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হল নিরাপদ পানি পান করা। আর্সেনিক মুক্ত নলকূপের পানি নিরাপদ। এই পানিতে কোন জীবাণু থাকে না। তবে নলকূপের চারপাশে বাঁধানো থাকতে হবে এবং নলকূপের কাছাকাছি কোন পায়খানা বা নর্দমা থাকতে পারবেনা।
বাড়ির কাছে নলকূপের পানি পাওয়া না গেলে পুকুরের বা কুয়ার পানি কমপক্ষে আধাঘন্টা ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করতে হবে।পানি ভালো ভাবে ফুটালে পানির মধ্যে থাকা রোগ জীবাণু মরে যায়। ফলে পানি নিরাপদ হয়। এছাড়াও পানি শোধনকারী ট্যাবলেট ব্যবহারের মাধ্যমেও নিরাপদ পানি পাওয়া যেতে পারে। পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্তি এবং সকলের সুস্বাস্থ্য, ও রোগমুক্ত জীবন কামনা করি।
আমার এ প্রতিবেদনটি ভালো লাগলে শেয়ার করবেন। তাহলে অন্যান্যরা ও এ তথ্য গুলো জানতে পারবে। এতক্ষণ থেকে এই প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url