পরিবেশের সংজ্ঞা,পরিবেশের গঠন কাঠামো বা গঠনকারী মন্ডল
প্রিয় পাঠক, "পরিবেশের সংজ্ঞা,পরিবেশের গঠন কাঠামো বা গঠনকারী মন্ডল" সমূহ সম্পর্কে তথা ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এই গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন লেখক এর বই পুস্তক ঘাটাঘাটি করেও মনের মত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাচ্ছেন না, তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমার আজকের এই প্রতিবেদনে পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের সংজ্ঞা, পরিবেশের গঠন কাঠামো, পরিবেশের গঠনকারী মন্ডল সমূহ যেমন- অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল, বারিমন্ডল, বায়ুমন্ডল, এবং জীবমন্ডল সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের শেষ পর্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়তে থাকুন বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ভূমিকা
আমরা যেখানে বসবাস করি তার চারপাশের যা কিছু জীব ও জড় বা প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক উপাদান দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো সব মিলিয়েই সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ। মানুষ ও তার চারপাশের সকল প্রকার উপাদানের সমন্বয়েই গঠিত হয় পরিবেশ অর্থাৎ জীবজগৎ ও জড় জগতের মিথস্ক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন পরিবেশ। মানুষসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীবাণু হতে অতিকায় প্রাণিকুল এবং অতি ক্ষুদ্রতায় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও শৈবালসহ বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষাদি এই জীবজগতের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে জড় বা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের মধ্যেসূর্যকিরণ, মাটি, পানি, পুষ্টি উপাদান ও আবহাওয়া জলবায়ুর অন্তর্গত। এ উভয় প্রকার উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে পরিবেশের সৃষ্টি এবং পরিবেশ টিকে থাকার জন্য মিথস্ক্রিয়া অপরিহার্য।
পরিবেশের সংজ্ঞা
ভূ-পৃষ্ঠস্থ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য যাবতীয় জৈব এবং অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত। প্রকৃতির সাথে জীবজগতের যে সম্পর্ক ও সহবাস্থান মূলত তাকেই পরিবেশ বলে। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই হল পরিবেশ, অর্থাৎ আমাদের চারপাশের যে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট অবস্থা বিরাজ করছে তাকে পরিবেশ বলে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি পরিবেশের সংজ্ঞা হিসাবে আলোকপাত করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১৯৭৪ সালে Jose de Castro যেভাবে প্রকাশ করেন তা হল-"পরিবেশ শুধুমাত্র জগতের পারস্পরিক সম্পর্কই নির্ণয় করে না বরঞ্চ প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে।"
C. Park (1980) এর মতে, "নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে মানুষের চারপাশের অবস্থান সমূহের সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে।"
ARMS (1984) এর মতে," জীব সম্প্রদায়ের পারিপার্শ্বিক জৈব ও প্রাকৃতিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে।"
The Oxford Dictionary (1992) -তে দেওয়া সংজ্ঞা মতে, "পরিবেশ হলো উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের উপর প্রভাব বিস্তারকারী চারপাশের অবস্থা গুলোর সমষ্টি।"
The Sociel Work Dictionary তে বলা হয়েছে," জীবনের বিকাশ ও বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থা ও প্রাকৃতিক সহ্যবস্থান কে পরিবেশ বলে।"
এক কথায় আমরা বলতে পারি, "পৃথিবীর সব কিছু যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত যথা-আলো, বাতাস, পানি, মেঘ, কুয়াশা, মৃত্তিকা,বন, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, মানুষ নির্মিত সর্বপ্রকার অবকাঠামো এবং গোটা উদ্ভিদ ও প্রাণী মন্ডল সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই পরিবেশ।"
পরিবেশের গঠন কাঠামো
পরিবেশের কাঠামো বলতে আমরা বুঝি পরিবেশের তথা পৃথিবীর জৈবিক এবং ভৌতিক উপাদান গুলোর মধ্যে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে গঠিত ফলাফল। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ গঠিত অর্থাৎ আমাদের চারপাশে রয়েছে শিলামন্ডল বা অশ্ব মন্ডল,বায়ুমণ্ডল, বারিমন্ডল ও জীবমন্ডল। সুতরাং পরিবেশের গঠন কাঠামোকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-
(ক) অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল (Lithosphere)
(খ) বারিমন্ডল (Hydrosphere)
(গ) বায়ুমণ্ডল (Atmosphere) এবং
(ঘ) জীবমন্ডল (Biosphere)
নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো-
(ক) অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল (Lithosphere)
পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন শিলাস্তর দ্বারা গঠিত কঠিন ভূ-ভাগ অর্থাৎ মৃত্তিকা ও প্রস্তুর স্তরের সমন্বয়ে গঠিত স্থলভাগকে বলে অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডল। অশ্বমন্ডলের উপরিভাগের জীবজগৎ গড়ে উঠেছে। ভূ- অভ্যন্তর ও বাইরে কার্যরত বিভিন্ন নিয়ামক ও শক্তি একত্রে অশ্বমন্ডলে বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপের সৃষ্টি করেছে। যেমন পাহাড়-পর্বত, মালভূমি, সমভূমি ইত্যাদি। তাছাড়া অশ্বমণ্ডল প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য অতি অত্যাবশ্যকীয় জৈব ও অজৈব উপাদান যোগায়। যা শিলা থেকে মৃত্তিকার মাধ্যমে জীবজগতে প্রবেশ করে।
অশ্বমণ্ডল বা শিলামন্ডলের বৈশিষ্ট্য
- অশ্বমণ্ডল পৃথিবীর কঠিন বহিরাবরণ তৈরি করেছে।
- বিভিন্ন ধরনের শিলা ও খনিজ পদার্থ নিয়ে গঠিত।
- ভূপৃষ্ঠের উপরে প্রায় সব জায়গায় মাটির আবরণ আছে।
- ভূত্বক দুইটি স্তর দ্বারা গঠিত। নিচের স্তরটি সিমা যা প্রধানত সিলিকন ও ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা গঠিত। সিমার ওপরের স্তরের নাম সিয়াল, যা প্রধানত সিলিকন ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা গঠিত।
- সিমা ও সিয়াল স্তরকে একত্রে লিথোস্পিয়ার বলে।
- ভূত্বকের পরবর্তী অভ্যন্তরভাগের স্তরকে বলে মেন্টোল।
বিস্তৃতি
পরিবেশ সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর অংশকে ধরা হয়।
অশ্বমন্ডলের গুরুত্ব
- ভূ-ত্বকের ওপরে মাটিকে কাজে লাগিয়ে চাষবাস করা যায়।
- ভূমির উপর ঘরবাড়ি নির্মাণ করা যায়। এছাড়া কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করা যায়।
- ভূ-গর্ভ থেকে জ্বালানি সম্পদ আহরণ করা যায়।
- মৃত্তিকার অভ্যন্তরস্থ ভূ-তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
(খ) বারিমন্ডল (Hydrosphere)
মহাসাগর, সাগর, উপসাগর, হ্রদ সমন্বয়ে বারিমন্ডল গঠিত। ভূপৃষ্ঠের অপরিভাগের শতকরা ৭১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে পানির রাশি। ভূপৃষ্ঠের আয়তন প্রায় ৩৬ কোটি ২৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। ভূ-ত্বকের অবনত অংশে অবস্থিত এই বিশাল পানিরাশিকে বারিমন্ডল বলে। বারিমন্ডল জীবজগতের আরেকটি প্রয়োজনীয় অংশ। পানির বিভিন্ন অবস্থা যেমন কঠিন তরল ও বায়বীয় নিয়েই বারিমণ্ডল গঠিত।
বারিমন্ডলের বৈশিষ্ট্য
- ভূ-পৃষ্ঠের সমগ্র আয়তনের প্রায় ৭১% শতাংশই জলমন্ডল দ্বারা বেষ্টিত।
- ভূ-পৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত সাগর-মহাসাগর, হ্রদ, জলাভূমি এর অন্তর্গত।
- জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ধারক ও বাহক। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি জলে পাওয়া যায়।
- বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য যেমন- ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, তামা ইত্যাদি পাওয়া যায়।
- সমুদ্রে জলে প্রচুর লবণ থাকে।
বিস্তৃতি
অশ্বমন্ডলের নিচু এলাকা জলে পরিপূর্ণ হয়ে বারিমণ্ডল তৈরি করেছে।
বারিমন্ডলের গুরুত্ব
- মানব সভ্যতার উপর বারিমন্ডলের প্রভাব অপরিসীম।
- শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, খাদ্য সরবরাহ, খনিজ সম্পদের ভান্ডার, শক্তি সম্পদের উৎস, মৎস্য সরবরাহ প্রভৃতিতে বারিমন্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
- জল পরিবহনের কাজে ও সহায়তা করে।
(গ) বায়ুমণ্ডল (Atmosphere)
হাজার হাজার কিলোমিটার পুরু যে বায়ুর সমুদ্র পৃথিবীর চারপাশে বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। এ গ্যাসীয় আবরণ পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এবং জীবজগতের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য বায়ুমণ্ডল দায়ী। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে জীবন ধারণকারী প্রক্রিয়া সফলের সুষ্ঠু সম্পাদনেও বায়ুমন্ডলের উপস্থিতি অপরিহার্য।
বায়ুমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য
- বায়ুমন্ডল হলো পৃথিবীকে ঘিরে থাকা গ্যাসীয় আবরণ।
- জীবনধারণের প্রধান উপাদান অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন হল বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান।
- নাইট্রোজেন (৭১.১০ %), আর্গণ (০.৯৩%) ও কার্বন ডাই অক্সাইড (০.০৩%) গ্যাসের প্রধান্য। তবে গ্যাসীয় বাষ্প, ভাসমান ধূলিকণা ইত্যাদি ও থাকে।
- কিলোমিটার উচ্চতায় ওজন গ্যাসের স্তর থাকে।
বিস্তৃতি
ভূত্বকের উপরিভাগের কয়েক মিটার থেকে এর শুরু এবং ঊর্ধ্বকাশে প্রায় ১০ ০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে এমন অবস্থা ট্রপোস্ফিয়ার বা ক্ষুদ্রমন্ডল (গড়ে ০ থেকে ১২ কিলোমিটার উচ্চতা) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বায়ুমন্ডলের গুরুত্ব
- বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তাপের সমতা বজায় রাখে।
- মহাকাশের ক্ষতিকর রশ্মিগুলিকে (অতি বেগুনি রশ্মি, মহাজাগতিক রশ্মি ইত্যাদি) প্রতিরোধ করে।
- বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বায়ু কলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- সমগ্র জীবজগতের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেনের উৎস হল বায়ুমণ্ডল।
- উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন ডাই-অক্সাইড এই বায়ুমণ্ডল থেকেই পায়।
(ঘ) জীবমন্ডল (Biosphere)
ভূপৃষ্ঠের যে কোন জায়গা জীবের বসবাসের উপযোগী পরিমণ্ডলকে জীবমন্ডল বা বায়োস্ফিয়ার বলে। জীবমন্ডল একাধিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। উপাদান গুলো হল বায়ুমণ্ডল বারিমন্ডল ও অশ্বমন্ডল। প্রতিটি উপাদানই কোন না কোন ভাবে জীবমণ্ডল কে প্রভাবিত করে।
জীব মন্ডল এর বৈশিষ্ট্য
- উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত ডিওযোজক বিয়োজক ও পরিবর্তকের সমষ্টি হল জীবন মন্ডল।
- জীবমন্ডলের প্রধান দুইটি ভাগ হলো-স্থলভাগের জীবমন্ডল ও জলভাগের জীবমন্ডল।
- উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্ম-মৃত্যু রয়েছে। তাই খনিজ সম্পদের মত উদ্ভিজ্জ সম্পদ ও প্রাণীজ সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যায় না।
বিস্তৃতি
ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উচ্চতা এবং ৭ কিলোমিটার গভীরতা পর্যন্ত জীবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ৬+৭ = ১৩ কিলোমিটার পুরো প্রায় গোলাকার সজীব স্তরই জীবন মন্ডলের অন্তর্গত।
মন্তব্য
আজকের এই প্রতিবেদনে "পরিবেশের সংজ্ঞা,পরিবেশের গঠন কাঠামো বা গঠনকারী মন্ডল" সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানকার তথ্যগুলি সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য করে উপস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন নামিদামি লেখক এর রিসার্চ এবং মন্তব্য এর সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি এ বিষয় সম্পর্কে সঠিক এবং নির্বাচিত তথ্য আপনি বুঝতে পেরেছেন। এ বিষয়ে সম্পর্কিত কোনো মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এই ওয়েবসাইটের এডমিন সকল মন্তব্যের জবাব প্রদান করে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url