বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং প্রতিটি অঞ্চলের বর্ণনা

প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং প্রতিটি অঞ্চলের বর্ণনা সম্পর্কিত বিষয় জানা বিশেষ প্রয়োজন, এই বিষয়ে জানার জন্য বা সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য কোন লেখকের বই সংগ্রহ করবেন বা কোন ওয়েবসাইট ভিজিট করবেন এটি নিয়ে চিন্তিত? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং প্রতিটি অঞ্চলের বর্ণনা

আমার আজকের এই প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের বিভক্তি, টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ি অঞ্চল, প্লাইস্টোসিন যুগের সোপান-বা চত্বর, সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি অঞ্চল, উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল সহ ভূ-প্রাকৃতিক বিভিন্ন অঞ্চলের সঠিক এবং তথ্যবহুল বর্ণনা। চলুন বিস্তারিত জেনে নিই।

ভূমিকা

বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা গঙ্গা ও ব্রক্ষপুত্র নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত। দেশের বেশিরভাগ জায়গা সমতল ও নিচু সমতল যা প্রায় প্রতিবছর বন্যায় প্লাবিত হয় এবং ভূমিতে প্রচুর পলি পড়ে বন্যার পানির মাধ্যমে। এই মাটি যথেষ্ট উর্বর। দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশের চেয়ে কম এলাকা পাহাড়ি অঞ্চল। যা দেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে সংকীর্ণ ভূভাগে অবস্থিত। মায়ানমার সীমান্তে দেশের মোদক মোয়াল সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া যার উচ্চতা প্রায় ১০৬৪ মিটার। আবার কোন কোন ভূগোলবিদদের মতে, দেশের সর্বোচ্চ পরবর্তী রা হলো কেউক্রাডং যার উচ্চতা প্রায় ১০১২ মিটার। আর ছোট ছোট পাহাড় দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

বাংলাদেশের ভূমিরূপ (Land Feature)

বাংলাদেশের ভূমিরূপ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দুই ধরনের। যথা- ব-দ্বীপীয় সমভূমি প্রায় প্রতিবছর প্লাবিত হয় ও ছোট পাহাড়িয়া এলাকা যেখানে খরস্রোত সম্পন্ন কিছু নদী আছে। দেশের মোট আয়তন ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার এবং দেশটির উত্তর দক্ষিনে ৮২০ কিলোমিটার ও পূর্ব পশ্চিমে ৬০০ কিলোমিটার প্রশস্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকে ৬০০ কিলোমিটার অস্থায়ী ব-দ্বীপীয় উপকূল রেখা রয়েছে যেখান দিয়ে অনেক নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।


সমুদ্রের দিকে উপকূল থেকে রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা হল ১২ নটিকাল মাইল এবং অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা হল ২০০ নটিকের মাইল। বাংলাদেশের উত্তরাংশের সমুদ্র সমতল থেকে ১০৫ মিটার অধিক উঁচু কিন্তু অন্যান্য অংশে ১০ মিটারের কম উঁচু। সাধারণত দেশের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে উচ্চতা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। দেশের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জরধার এবং প্রতিবছর ব্যাপক এলাকা বর্ষাকালে বন্যায় প্লাবিত হয়। ভূগোলবিদ গণের শ্রেণীবিভাগ এর আলোকে বাংলাদেশের ভূমিরূপ কে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
১। টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ি অঞ্চল
২। প্লাইস্টোসিন যুগের সোপান-বা চত্বর
৩। সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি অঞ্চল এবং
৪। উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল।

১। টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ি অঞ্চল

বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার আয়তন প্রায় ১৩২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। দেশের মোট আয়তনে প্রায় ১০ পার্সেন্ট হল পাহাড়ি এলাকা। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি এলাকাটি অবস্থিত। বাংলাদেশের পাহাড়গুলো প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বের টারশিয়ারি অধিযুগে ভূ আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট আরাকান লুসাই ও গারো পাহাড়ের অংশবিশেষ। এই সমস্ত পাহাড় বেলেপাথর শ্লেটপাথর ও কাদার মিশ্রণে গঠিত হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়িয়া অঞ্চল (Southeastern Hills Region) এবং
(খ) উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি বা টিলা অঞ্চল (Northeastrn Hills Region)

(ক) দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়িয়া অঞ্চল (Southeastern Hills Region)

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সমস্ত পাহাড়িয়া অঞ্চল চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি কক্সবাজার ও বান্দরবান এই পাঁচটি জেলার সবকটিতেই কমবেশি পাহাড় রয়েছে। এখানকার পাহাড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাহাড় গুলো ভাঁজ বিশিষ্ট অর্থাৎ ভঙ্গিল পর্বত শ্রেণীর। আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পাহাড় গুলো পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ক্রমশ উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

(খ) উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি বা টিলা অঞ্চল (Northeastrn Hills Region)

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ সিলেট সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার জেলা এবং শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশে বিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত টিলা গুলো ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে সৃষ্ট খাসিয়া জয়ন্তিয়া গারো ও লুসাই পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন অংশ। সমুদ্র সমতল থেকে এই সব টিলার উচ্চতা সর্বোচ্চ ৯১ মিটারের বেশি নয়।

২। প্লাইস্টোসিন যুগের সোপান-বা চত্বর

প্লাস্টোসিন যুগের সোপান বা চত্বর সমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

মধুপুরের গড় এলাকা

মধুপুরের গড় বাংলাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত একটি উঁচু এলাকা। এই গড়ের দক্ষিণাংশ ভাওয়ালের গড় ও উত্তরাংশ মধুপুরের গড় নামে পরিচিত। ভূতাত্বিক ভাগে এ এলাকাটি পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমি থেকে এক থেকে দশ মিটার উঁচু। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই গড় মাইওসিন যুগের পর প্লেস্টোসিন যুগের উৎপত্তি হয় তখন বঙ্গকাহাত দ্রুত ভরাট হচ্ছিল। এই পাহাড়ের আয়তন প্রায় ৪ হাজার ২৪৪ বর্গ কিলোমিটার। এটি বরেন্দ্র ভূমির মতো নয়। এই গড় সাতটি অংশে বিভক্ত। প্রধান অংশটি উত্তর দিকে জামালপুরের দক্ষিণ থেকে দক্ষিণের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা এই গড়ের মধ্যে অবস্থিত। সাতটি অংশের মধ্যে চারটি হল পূর্বে এবং তিনটি উত্তরে অবস্থিত।

মধুপুর গড় এলাকার ছবি

এই গড়ের তাপের পার্থক্য গ্রীষ্মকালে ২৮ ডিগ্রি সে থেকে ৩২ ডিগ্রী সে শীতকালে 20° c এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সে পৌঁছায়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার মিলিমিটার। মধুপুরের মৃত্তিকা অনুর্বর এবং কিছু ক্ষারযুক্ত মৃত্তিকার রং লাল অথবা বাদামি। তবে এখানকার উপরের মৃত্তিকার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয়ভাবে এখানকার উচ্চভূমি চালা এবং নিশু উপত্যকা কে বলা হয় বেইদ নামে পরিচিত।

বরেন্দ্রভূমি

প্লাইস্টোসিন যুগে সৃষ্ট বাংলাদেশ যে তিনটি চত্বর রয়েছে তার মধ্যে বরেন্দ্র চত্বর বা সোপান সবচেয়ে বড়। এর ভৌগলিক অবস্থান ২৪ ডিগ্রি ২০ মিনিট থেকে ২৫ ডিগ্রি .৩০ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮০ ডিগ্রী ২০ মিনিট থেকে ৮৯° ৩০ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমা। সোপান টির পূর্বে করোতোয়া নদী, পশ্চিমে মহানন্দা নদী এবং দক্ষিণের গঙ্গা নদীর উত্তর তীর অবস্থিত। এই ভূমি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৭৭৭০ বর্গ কিলোমিটার। এই ভূমি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ঢালু। পশ্চিম প্রান্ত অন্যান্য অংশ এবং প্লাবনভূমি অপেক্ষা প্রায় ১৫ মিটার উঁচু।

বরেন্দ্র এলাকার মানচিত্র

এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০° থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মকালে এখানকার তাপমাত্রা ৩৫° সেলসিয়াস থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাজশাহী অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের কোন কোন দিন তাপমাত্রা ৪৫° সেলসিয়াস বা তারও বেশি হয়। লালপুর উপজেলার শীতকালে কোন কোন সময় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। ভূমির গঠন অনুসারে বরেন্দ্রভূমি এলাকাতে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(I) সাম্প্রতিক কালের পলিজ সমভূমি (Recent Alluviel Fan)
(II) প্লাইস্টোসিন যুগের বরেন্দ্র এলাকা (Briend Pleistocene) এবং
(III) সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি (Recent Floodplain)

কর্কটক্রান্তি রেখার উত্তরে বরেন্দ্রভূমি এলাকা অবস্থিত। আর্দ্রতা ও জলবায়ুর চাপের উপর ভিত্তি করে এখানকার আবহাওয়ার অবস্থাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (I) বর্ষাকালের পূর্বাবস্থা, (II) বর্ষাকাল (III) বর্ষা পরবর্তী অবস্থা এবং (IV) শীতকাল। এখানে বর্ষাকাল সংক্ষিপ্ত বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১৯৭১ মিলিমিটার। বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত বর্ষাকালে হয়ে থাকে।

বরেন্দ্র এলাকা পার্শ্ববর্তী প্লাবন সমভূমি অপেক্ষা যথেষ্ট উঁচু। বরেন্দ্রভূমির প্রায় ৪৭% এলাকা উঁচুভূমি, ৪১% মধ্যভূমি এবং ১২% এলাকা নিম্নভূমি। এলাকার ৮০ % কৃষি জমি উচ্চভূমির ঢালে অবস্থিত। এই এলাকাটির মৃত্তিকা প্লায়স্টোসিন যুগের তলানি থেকে উৎপত্তি যা মধুপুরের মৃত্তিকা নামের পরিচিত। এই মৃত্তিকার রং লাল বাদামী। প্রকৃতপক্ষে এই মৃত্তিকা প্লেস্টোসিন যুগের শেষ দিকে বরফ যুগ শেষ হবার পূর্বে সঞ্চিত হয়েছিল। সর্বশেষ বরফ যুগ প্রায় ১৮ হাজার বছর পূর্বে শেষ হয়েছিল।

বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চমানের বিটুমিন জাতীয় কয়লা পাওয়া গেছে। প্রধানত এই কয়লা রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এ কয়লা বিচ্ছিন্ন বেসিনের প্লাইস্টোসিন যুগের সঞ্চিত তলানির নিচে পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত কয়লার গুণগত মান খুবই ভালো। অত্র বরেন্দ্র এলাকার দক্ষিণ দিকে চুনাপাথর পাওয়া গেছে। কঠিন শিলা এই এলাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ, প্রকৃতপক্ষে ওই এলাকার প্ল্যাটফর্মটি প্রাক-ক্যারিবিয়ান যুগের আগ্নেয়শিলা দ্বারা গঠিত। এ কঠিন শিলা সড়ক, ব্রিজ, ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ।

লালমাই পাহাড় চত্বর

লালমাই পাহাড়টি কুমিল্লা শহর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৫ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৩৩ বর্গ কিলোমিটার। সমুদ্র সমতল থেকে এর গড় উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার এবং সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা প্রায় ৪৫ মিটার। এই চত্বরটি উত্তর-দক্ষিণের বিস্তার প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তার ১.৫ কিলোমিটার। এখানকার মাটির রং লাল এবং মাটিতে বালি ও কাদার মিশ্রণ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এলাকাটিকে সামরিক কাজে ব্যবহার করছে। সমগ্র এলাকাটি উদ্ভিদ দ্বারা আচ্ছাদিত।

৩। সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি (Floodplains Area)

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী এবং এদের উপনদী ও শাখা নদী দেশের প্রায় ৮০% এলাকাকে বিধত করে। দেশের প্লাবনভূমির আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার ২৬৬ বর্গ কিলোমিটার। বর্ষাকালে পাহাড়ি ও চত্বর এলাকা ব্যতীত প্রায় সমগ্র দেশের সমভূমি প্লাবিত হয়। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী গুলোর মাধ্যমে প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরের ২.৪ মিলিয়ন পলি সঞ্চিত হয়। এর মাধ্যমে অনেক দ্বীপের ও সৃষ্টি হয়। যেমন-হাতিয়া, ভোলা, সন্ধিপ, মনপুরা, তালপট্টি প্রভৃতি,দ্বীপ নদীবাহিত পলি দ্বারা সৃষ্ট। দেশের সমভূমি এলাকায় অনেক বিল হাওর, বাওর এবং চরাভূমি রয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই জলাধার সমূহ নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়। আবার কিছু কিছু বিল ভূ-আন্দোলনের সময় ভূভাগ অবনমনের ফলে সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমিকে সাত ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১।পাদদেশীয় পলিজ সমভূমি (Foothills Deposition Plain)

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট জেলা সমুদয় অংশ এবং কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরাংশ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। হিমালয় পর্বত হতে তিস্তা, করোতোয়া, আত্রাই প্রভৃতি নদী দ্বারা আনীত বালুময় পলি দ্বারা এই সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্র সমতল থেকে এখানকার উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার। কখনো কখনো পাহাড়ি ঢলে এই সমভূমি প্লাবিত হয়। এ অঞ্চলে ধান, পাট ও তামাকের চাষ ভালো হয়।

২। তিস্তা প্লাবন সমভূমি (Teesta Footplain)

তিস্তা প্লাবন সমভূমিটি পশ্চিমে করতোয়া নদীর পূর্ববর্তী এবং পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম তীরে পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তরে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে দক্ষিনে বগুড়া জেলার শেরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ জয়পুরহাট, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া জেলার আংশিক এবং কুড়িগ্রাম জেলার দক্ষিণাংশন এই সমভূমির আওতাভুক্ত। এর সমভূমির মধ্যে দিয়ে ধরাল, দুধকুমার ও তিস্তা নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই এলাকার ভূমি সমুদ্র সমতল থেকে বেশ উঁচু হলেও বর্ষাকালে বা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়।

৩। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবন সমভূমি (Brahmaputra-Jamuna Foodplain)

এই প্লাবন সমভূমি প্রধানত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বাহিত পলি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ভূমিকায় বেশি। জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলা, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলার দক্ষিণাংশ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার মধুপুরের গড় এলাকা ব্যতীত এই অংশ এই প্লাবন সমভূমির আওতাভুক্ত। যমুনা নদীর তীরবর্তী বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার অংশবিশেষ ও এই সমভূমির অন্তর্গত। যমুনা নদীতে অনেক চরের উৎপত্তি হয়েছে। যে চরগুলো নদী ভাঙ্গনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে সাধারণত বর্ষাকালে এই প্লাবন সমভূমি কখনো কখনো প্লাবিত হয়।

৪। গাঙ্গেয় প্লাবন সমভূমি (Ganges Floodplain)

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার সুমুদয় অংশ এবং ঢাকা, রাজশাহী ও পাবনা জেলার আংশিক এই উপকূল উপকূলীয় ব-দ্বীপ এলাকার অন্তর্গত। এখানকার নদীগুলো পলি দ্বারা ভরাট হয়ে এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে উজান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই এলাকার উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হল মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, হরিহর, বুড়িভদ্রা, কপোতাক্ষ প্রকৃতি। এই নদীগুলো বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ছাড়া জোয়ার ভাটা বা উজান প্রবাহ নেই।

৫। মেঘনা প্লাবন সমভূমি (Meghna Floodplain)

সমগ্র কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এবং মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের জেলার দক্ষিণাংশ এই সমভূমির অন্তর্গত। ভৈরব বাজার থেকে চাঁদপুর জেলার মতলব পর্যন্ত মেঘনা নদীতে অনেক চরের সৃষ্টি হয়েছে। মেঘনা নদীর উজানের অববাহিকায় ভারী বর্ষণের কারণে নিম্ন মেঘনায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং প্লাবন দেখা দেয়।

৬। সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবন সমভূমি (Surma-Kusiyara Floodplain)

এই প্লাবন সমভূমিটি সিলেটের পূর্ব দিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে সুরমা, কুশিয়ারা নদী বাহিত পলি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর পাহাড়ি ঢল তথা বন্যা দ্বারা এলাকাটি প্লাবিত হয়। পাশাপাশি এখানে ভারী বর্ষণজনিত কারণে স্বাভাবিক বন্যাও হয়ে থাকে। এই প্লাবন সমভূমির পাশে সিলেটের হাওর অবস্থিত।

৭। চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী সমভূমি (Chitaagong Coastal Plain)

চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা অর্থাৎ ফেনী নদী থেকে মাথা মুহুরী বদ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমভূমি অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানত ফেনী, কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, বাঁশখালী, মাথামুহুরী প্রভৃতি নদীবাহিত পলি দ্বারা এই সমভূমি গঠিত হয়েছে। এর সমভূমিতে ও পাহাড়ে ঢল বন্যা হয়ে থাকে। নদীর মোহনায় প্লাবনভূমির লবণাক্ততা বেশি। তবে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত বৃদ্ধি পায়।

৪। উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল (Coastal Deltic Area)

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ভৌগোলিক পরিবেশ পরিবর্তনশীল। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি জনিত কারণে সমুদ্র সমতল পরিবর্তিত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় যেখানে সমুদ্রে নদী পতিত হয়েছে সেখানে অর্থাৎ মোহনা এলাকায় ভূমির পরিবর্তন বেশি পরিলক্ষিত হয়। যেমন যমুনা নদীর মোহনায় এমন পরিবর্তন বেশি।

সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থলভাগের স্থানের সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রপঞ্জ সর্বদা ক্রিয়াশীল সে অঞ্চলকে উপকূল বলে। সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রপঞ্জ যেমন-জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, সামুদ্রিক বায়ু, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন প্রভৃতি উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায় বেশি ক্রিয়াশীল। ভূ-বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলকে দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

১। সক্রিয় ব-দ্বীপ বা গঙ্গেয় জোয়ার-ভাটা সম্পূর্ণ অঞ্চল

পূর্বে মেঘনা নদীর মোহনা হতে পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদীর জোয়ার ভাটা সম্পূর্ণ এলাকা পর্যন্ত অঞ্চল সক্রিয় ব-দ্বীপ এলাকার অন্তর্গত। এই এলাকায় বর্ষাকালে নদীর দুই কুল ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী প্লাবন সমভূমিতে পলি সঞ্চয়ের মাধ্যমে ভূমির গঠনকার্য চলমান রয়েছে। এ অঞ্চলে অনেক বিল রয়েছে, যার গঠনকার্য এখনো সমাপ্ত হয়নি। আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, কপোতাক্ষ প্রভৃতি এখানকার নদী।

২। স্রোতজ বা মোহনাস্থ ব-দ্বীপ

বঙ্গোপসাগরে পতিত বিভিন্ন নদীর মোহনায় নদী বাহিত পলি দ্বারা সৃষ্ট ব-দ্বীপ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। বিশেষ করে মেঘনা নদীর মোহনায় ভোলা, হাতিয়া, সন্দীপ এবং বিভিন্ন চর এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

মন্তব্য

এতক্ষণ ধরে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলকে শ্রেণীবিভাগ করে এবং উপশ্রেণী বিভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি, বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের বিভক্তি এবং প্রত্যেকটি অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পেয়েছেন। এই লেখাটির বিষয়ে যদি কোন মন্তব্য থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এই ওয়েবসাইটের এডমিন সকল মন্তব্যকে ইতিবাচক হিসাবে গ্রহণ করে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url