ভূগোলের সংজ্ঞা, ভূগোলের পরিধি এবং বিষয়বস্তু বর্ণনা
প্রিয় পাঠক, আপনি কি ভূগোলের সংজ্ঞা, ভূগোলের পরিধি এবং বিষয়বস্তু বর্ণনা বিস্তারিত তথ্য জানতে চাচ্ছেন, এ বিষয়ে জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই-পুস্ত ঘাটাঘাটি এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করছেন? তাহলে আপনি সঠিক জায়গায় এসেছেন। আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে ভূগোল কাকে বলে বা ভূগোলের সংজ্ঞা, ভূগোলের পরিধি, ভূগোলের বিষয়বস্তু সহ ভূগোলের আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুরোপুরি জানতে হলে ধৈর্যের সহিত প্রতিবেদনটি মনোযোগের সহিত পড়তে থাকুন।
ভূমিকা (Introduction)
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষের বুদ্ধি, জ্ঞান বিকাশের প্রথম ধাপে ছিল ভূগোল একটি শব্দ মাত্র। পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সৃষ্টি, আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি, ভূপৃষ্ঠ, বারিমন্ডল, বায়ুমণ্ডল, জীবমন্ডল, পাহাড় পর্বত, দিন-রাত সংগঠন প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার পর ভূগোল একটি বিষয় ও পাঠ্য হিসেবে পরিস্থিতি লাভ করে। প্রাচীন সভ্যতার গ্রিক পন্ডিত ইরাটোসথেনিস জিওগ্রাফি ( Geography ) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। জিও (Geo) এবং গ্রাফিয়া (Graphia) এই দুইটি গ্রিক শব্দ থেকে দিয়ে তিনি জিওগ্রাফি ( Geography ) নাম করণ করেন। এটি সর্বপ্রথম ভূগোল ধারণার সূত্রপাত বলে ভূগোলবিদ গণের ঘোষণা। জিও (Geo) অর্থ কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থ নিয়ে গঠিত পৃথিবীর এবং গ্রাফিয়া (Graphia) বলতে পৃথিবীর বর্ণনা দ্বারা ইরাটোসথেনিস বোঝাতে চেয়েছেন, জিওগ্রাফি ( Geography ) হচ্ছে মানুষের আবাসস্থল বা পৃথিবীর বর্ণনা।
ভূগোলের সংজ্ঞা (Definition of Geography)
পৃথিবীপৃষ্ঠ বৈচিত্র্যময়। এছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে ভূপৃষ্ঠ প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, হিমবাহ, নদীর গতি পরিবর্তন, জলবায়ুর পরিবর্তন, ভূগাঠনিক প্লেটের সঞ্চারণ প্রভৃতি কারণে ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তিত হচ্ছে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে ভৌগোলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং ভৌগলিক জ্ঞান বিকাশের প্রচেষ্টার ফলে নানাভাবে ভূগোল শাস্ত্রের পরিবর্তন হয়েছে এবং নতুন নতুন ভৌগোলিক জ্ঞানের উদ্ভাবন সংযোজিত হয়েছে। কখনো বৈচিত্রের বিজ্ঞান হিসেবে আবার কখনো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, মানব ভূগোল, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে, আঞ্চলিক বিজ্ঞান আবার কখনো বা পারিসরিক বিজ্ঞান হিসেবে ভূগোলকে অধ্যায়ন করা হয়েছে। তবে যে পরিচয় ই দেওয়া হোক না কেন ভূগোল বা Geography শব্দটি আজও সমান জনপ্রিয় এবং ভূগোলের মূল উদ্দেশ্য হিসাবে পৃথিবী ও মানুষের কাছে তা আজও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। যার ফলে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান আধুনিক কালের সংজ্ঞার মধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
ভূগোল শাস্ত্রের সংজ্ঞা প্রদানের ইতিহাসকে মোট তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। পর্যাগুলো হল-
১। প্রাচীন যুগীয় সংজ্ঞা (Ancient Definitions)
২। মধ্যযুগের সংজ্ঞা (Medieval Definitions)
৩। আধুনিক বা সাম্প্রতিককালের সংজ্ঞা (Modern or Recent Definitions)
১। প্রাচীন যুগীয় সংজ্ঞা (Ancient Definitions)
প্রাচীন যুগে ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্যময় চরিত্রের বর্ণনাই ছিল ভূগোলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকালে ভূগোলের সাধারণ সংজ্ঞা হলো পৃথিবীর বর্ণনা কে ভূগোলের সংজ্ঞা বলে।
ইরাটোসথেনিস
প্রাচীন সভ্যতার গ্রিক পন্ডিত ইরাটোসথেনিস জিওগ্রাফি ( Geography ) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "পৃথিবীর বর্ণনাই হলো ভূগোল"।
স্ট্রাবো
প্রাচীন রোমান সভ্যতার পন্ডিত স্ট্রাবো ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, "ভূগোল আমাদেরকে পৃথিবীর পানি রাশি ও স্থল ভাগের মধ্যে সমস্ত জীব সম্পর্কে জ্ঞান দেয় এবং একইভাবে ব্যাখ্যা করে পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে"।
ক্লোডিয়াস টলেমি
প্রাচীন রোমান পন্ডিত ক্লোডিয়াস টলেমি ভূগোল কে একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র হিসেবে রুপায়ন করেন, তিনি উল্লেখ করেন," ভূগোল সেই মহান বিজ্ঞান যা মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবীকে এক ঝলক দেখায়"। টলেমির ভূগোলের সংজ্ঞা ছিল এই রূপ," যে শাস্ত্র পাঠ করলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের অবস্থান ও সমুদ্র পথের বিবরণ বিশদভাবে অবগত হওয়া চাই তাকেই ভূগোল বলে।"
২। মধ্যযুগের সংজ্ঞা (Medieval Definitions)
রোমান সভ্যতা ধ্বংসের পর যখন সমগ্র ইউরোপের সমাজ ও সংস্কৃতিতে অন্ধকার বা অবসাদ এর সূচনা হয়েছিল ভৌগোলিক জ্ঞান বিকাশ ধারণার ক্রম বিকাশের ইতিহাসে সেই সময়কে মধ্যযুগ বলা হয়। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৩০০ সাল থেকে ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত মধ্যযুগের সময়কাল।
মধ্যযুগের ভূগোলের সংজ্ঞা হলো, পৃথিবীর জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, মাটি, নদ-নদী, পাহাড়, পর্বত, প্রাণীজ, উদ্ভিজ্জ, কৃষি, শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, জনসংখ্যা ও মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী বর্ণনা করা।
ভ্যারিনিয়াস
ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগের ভ্যারিনিয়াস প্রথম ভূগোলকে প্রাকৃতিক ও মানবিক এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন। ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "ভূগোল হচ্ছে গণিতের মিশ্রিত অংশ যা পৃথিবীর অবস্থা এবং এর অংশ সমূহের পরিমাণগত, যেমন-এর আকার, স্থান, বিশালতা এবং গতি, সেই সাথে মহাকাশ সম্পর্কিত বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করে।"
ইমানুয়েল কান্ট
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেন, "ভূগোল হচ্ছে পৃথিবীর সমীক্ষা। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বৈচিত্র্যতা ব্যাখ্যা করে।"
৩। আধুনিক বা সাম্প্রতিককালের সংজ্ঞা (Modern or Recent Definitions)
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভূগোলের আধুনিক যুগ শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৮ শতকে সাগর, মহাসাগরে ও স্থলপথে বিভিন্ন দুঃসাহসিক ভৌগোলিক জ্ঞান অনুসন্ধান অভিযান শুরু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় মহাদেশের ফ্রান্স, জার্মান ও ব্রিটেনে এক ঝাঁক ভূগোলবিদদের আবির্ভাব ঘটে এবং ভূগোল শাস্ত্রকে পৃথিবীর ভৌগোলিক জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডারে পরিণত করেন।
এই শতাব্দীতে নির্মিত ভূগোলশাস্ত্রকে আধুনিক ভূগোলের (Modern Geography) মহাযুগ বলে। আধুনিক ভূগোল মনীষীদের আধুনিক ভূগোল নির্মাণকারী (Makers of Modern Geography) বলা হয়। এ সময় ভূগোলবিদগণ ভূগোলের নতুন নতুন সংজ্ঞা প্রদান করেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো।
আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট (Alexander Von Humbolt)
আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট এবং কার্ল রিটারকে যুগ্মভাবে ভূগোলকে আধুনিক ভূগোলের রূপকার বলা হয়। হামবোল্ট ভূগোলকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান বলে প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "পৃথিবীতে যা কিছু দৃশ্যমান তার সব কিছুর বর্ণনা করাই হলো ভূগোলের অংশ।"
অধ্যাপক কার্ল রিটার (Carl Ritter)
অধ্যাপক কার্ল রিটার ভূগোলকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ভূগোল হল বিজ্ঞানের সেই বিভাগ যা গোলকের ভূমিরূপ, প্রণালী ও সম্পর্ককে স্বাধীন অংশ হিসাবে আলোচনা করে এবং এগুলোর সমষ্টির সাথে মানুষ ও মানুষের প্রকৃতি যোগাযোগ প্রদর্শন করে।
তিনি আরো সংজ্ঞায়িত করেন, "ভূগোল হল প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানব জাতির মধ্যে আন্তঃক্রিয়া বিষয়ক একটি পঠন-পাঠন।"
পল ভিডাল ডি লা ব্লাস (Paul Vidal de la Blache)
ফরাসি ভূগোলবিদ পল ভিডাল ডি লা ব্লাস ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন যে, "ভূগোল হলো স্থানসমূহের বিজ্ঞান-মানুষের নয়।"
ভূগোলবিদ হার্টশোর্ন (Hartshorne)
ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন যে, "ভূগোল হলো ভূপৃষ্ঠের চলমান বৈশিষ্ট্যের সঠিক, সাজানো এবং যৌক্তিক বর্ণনা এবং বিশ্লেষণের সাথে সংশ্লিষ্ট।"
কার্ল ও সাওয়ার (Karl O Saur)
কার্ল ও সাওয়ার জার্মানির ভূগোলবিদ। তিনি ভূগোলের আধুনিক সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন, "ভূগোল কোনদিনই মানুষ সম্পর্কিত বিজ্ঞান ছিল না। ভূগোল ছিল ভূপৃষ্ঠের ভূমি সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান যেখানে মানুষ বসবাস করে।"
মনখহাউজ (Monkhouse)
ব্রিটিশ ভূগোলবিদ মনখহাউস ভূগোলের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেন যে, "মানুষের আবাসভূমি হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পারিসরিক পার্থক্যের পঠন-পাঠনকে ভূগোল বলে।"
অধ্যাপক ডাডলি স্ট্যাম্প (Sir Dudlley Stamp)
ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট ভূগোলবিদ অধ্যাপক ডাডলি স্ট্যাম্প ভূগোলের তিনটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। তার সংজ্ঞা তিনটি হলো-
(I) ভূগোলে পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা করা হয়।
(II) ভূগোল পৃথিবীর তথা মানুষের পরিস্থিতি সমূহের বিজ্ঞান।
(III) ভূগোল ভূপৃষ্ঠের বর্ণনা ও এলাকার সমূহের সম্বন্ধে বিষয়ে আলোচনা করে।
ফ্রেডারিক রাটজেল (F. Ratzel)
প্রখ্যাত জার্মান ভূগোলবিদ ফ্রেডারিক রাটজেল বলেন, "ভূগোল হলো ভূপৃষ্ঠের এবং এর অধিবাসীদের একটি বিজ্ঞান।"
ব্রিটিশ ভূগোলবিদ পিটার হাগেট (Peter Haggett)
পিটার হেগেট ভূগোল চর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ভূগোলের বিভিন্ন সংজ্ঞা দেন। যেমন-তিনি বলেন, "ভূগোল হলো বিজ্ঞানের সকল শাখার মধ্যে একমাত্র এবং একক বিষয়ে যা দেখায় বিশ্বাস করে।"
১৯৭২ সালে পিটার হাগেট ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "ভূগোল হল সে বিজ্ঞান যা ভূপৃষ্ঠে মানুষের পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র এবং অঞ্চলের পারিসরিক গঠন এবং তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে সমীক্ষা করে।"
১৯৮১ সালে পিটার হাগেট নতুন করে ভূগোলের সঙ্গে বলেন যে, "ভূগোল হলো একটি পরিসর হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পঠন-পাঠন যে পরিসরে মানুষ বাস করে।"
গ্রিফিথ টেলর (Griffith Taylor)
অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত ভূগোলবিদ গ্রিফিথ টেলর ভূগোলের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেন যে," ভূগোল হলো মানুষ এবং প্রাকৃতিক প্রাণীগুলোর মধ্যে সম্পর্কের পঠন-পাঠন যা অশ্ব মন্ডল, বায়ুমণ্ডল এবং পানিমন্ডলে সংঘটিত হয়।"
আর্থার হোমসের
প্রখ্যাত ভূগোলবিদ আর্থার হোমসের এর মতে," পৃথিবীর পৃষ্ঠের বন্ধুরাতা, সাগর, মহাসাগর এবং বায়ুমণ্ডলের বিষয়াদি নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠিত তার গবেষণা বা সমীক্ষা হচ্ছে ভূগোলের আধুনিক সংজ্ঞা।"
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী
বাংলাদেশের ভূগোলবিদ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর মতে আধুনিক ভূগোলের সংজ্ঞা হলো," যে শাস্ত্র পাঠে আমরা গোলাকার পৃথিবীর স্থলভাগ, জলভাগ ও বায়ুমন্ডলে অস্বাভাবিক অবস্থার বিবরণ জানতে পারি এবং এ সব প্রাকৃতিক অবস্থা কিরূপে মানুষের জীবন ও কর্মধারার উপর প্রতিফলিত হয় তার ব্যাখ্যা বুঝতে পারি, তাকেই ভূগোল বলে।"
ডক্টর কাজী আব্দুর রউফ
বাংলাদেশের ভূগোলবিদ ডক্টর কাজী আব্দুর রউফ তার রচিত গ্রন্থ প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি তে উল্লেখ করেন, "বিজ্ঞানের যে শাখা অধ্যয়নের ফলে ভূত্বকের উপরিভাগের ভৌত পরিবেশ এবং তাতে কার্যরত বিভিন্ন ভূত্বকের উপরিভাগের ভূ প্রাকৃতিক ক্রিয়াগুলো সম্পর্কে জানা যায় তাকে ভূগোল বলে।"
উপরের বিভিন্ন ভূগোলবিদদের সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, পৃথিবীর জল পাহাড়-পর্বত মৃত্তিকা অরণ্য আবহাওয়া ও জলবায়ু দেশান্তরের মানুষ ও মানুষের প্রয়োজনে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ভাগ্য ও কার্যক্রমে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বা উন্নতি বা অবনতি কি ভূমিকা পালন করছে এটিই ভূগোলের মর্মকথা।
ভূগোলের বিষয়বস্তু (Subject matter of Geography)
বিষয় হিসেবে ভূগোল হচ্ছে সকল বিষয়ের আদি মাতা এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থা এবং অপ্রাকৃতিক অবস্থাসমূহের বর্ণনা করে। সময়ের পরিবর্তনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভূমিরূপ এর সৃষ্টি, প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন, নতুন নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ভৌগোলিক চিন্তা-ধারণার বিকাশ, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন নতুন দর্শন এসে ভূগোলের বিষয়বস্তুতে ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। এমনকি সমসাময়িক কালের ভূগোল আর সেই আদিকালের ভূগোল নেই। এজন্য ভূগোলের বিষয়বস্তু এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে তা নির্ধারণ করা কঠিন।
পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সভ্যতার ভূগোলবিদগণ, মুসলিম যুগের ভূগোলবিদগণ এবং রেনেসাঁকালীন ভূগোলবিদগণ, ভৌগোলিক জ্ঞান চর্চার বিদ্যা হিসেবে ভূগোল একমাত্র একটি একক বিষয় হিসেবে ভূগোল বিষয়বস্তুকে সামগ্রিকভাবে জানার জন্য কয়েকটি মৌলিক ধারণার ব্যবহার করা হয়। যেমন-
(ক) প্রকৃতির সৃষ্টি উপাদান,
(খ) প্রকৃতির বিষয়বস্তু এবং
(গ) মানবীয় ভূগোলের বিষয়বস্তু।
(ক) প্রকৃতির সৃষ্টি উপাদান ঃ
প্রকৃতির সৃষ্টির উপাদানগুলো যেমন অশ্বমণ্ডল, শিলামন্ডল, বায়ুমণ্ডল ও সৌরজগৎ, জীবমন্ডল এবং পাহাড় পর্বত, মালভূমি, নদনদী প্রভৃতি ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে ভূগোল গ্রন্থে আলোচনা করা হয়।
(খ) প্রকৃতির বিষয়বস্তু ঃ
সৌরজগতের চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের গঠন প্রণালী ও স্তরবিন্যাস এবং পৃথিবীর উপরিভাগের শিলামন্ডল, বারিমন্ডল, বায়ুমণ্ডল, জীবমন্ডল প্রভৃতি প্রাকৃতিক ভূগোলের উপক্ষেত্র হলেও ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে বর্ণনা করা হয়। নিম্নে এসবের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল-
(I) শিলামন্ডল (Lithosphere) ঃ
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের কঠিন বহিরাবরনকে শিলামন্ডল বা অশ্বমণ্ডল বলে। আমরা এই শিলামন্ডল বা অশ্বমন্ডলের উপরে বসবাস করি বলে এটি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর উৎপত্তি ও বিবর্তন, শিলার উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য, শিলার ব্যবহার, শিলা ও খনিজের অর্থনীতির গুরুত্ব, পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয়তা, ভূমিরূপ, ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তি, ভূমিক্ষয়ের কারণ, পাহাড়,পর্বত, মালভূমি, নদনদী প্রভৃতি ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
(II) বায়ুমণ্ডল (Atmosphere) ঃ
বায়ুমণ্ডল নিয়ে বর্ণনা ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। আমাদের চারপাশে যে বিশাল বায়ুর সাগর বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে বায়ুমণ্ডল সংযুক্ত থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। বায়ুমন্ডলের উৎপত্তি, বয়স, গঠন ও এর বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব সহকারে ভূগোলে আলোচনা করা হয়। এছাড়া বায়ুর তাপমাত্রা, বায়ুরচাপ ও বায়ুপ্রবাহের কারণ, বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদান এবং জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি ভূগোলের বিষয়বস্তু হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
(III) বারিমন্ডল (Hydrosphere) ঃ
সাগর,মহাসাগর, হ্রদ, উপসাগর প্রভৃতি নিয়ে বারিমন্ডল গঠিত। আবার পানির অপর নাম জীবন। এজন্য বারিমন্ডল ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয়। সাগর,মহাসাগরের আয়তন, গভীরতা, পানির বৈশিষ্ট্য, পানির লবণাক্ততা, পানির উষ্ণ ও শীতলতার প্রভাব, মহাসাগরের মহীসোপান, মহীঢাল, ঝিনুকঅঞ্চল, তটদেশীয় অঞ্চল, সাগর,মহাসাগরের তলদেশের অফুরন্ত মূল্যবান সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, প্রভৃতির কারণে বারিমন্ডল ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। আবার সমুদ্র স্রোতের সাথে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর প্রভাব, জোয়ার ভাটার প্রভাব প্রভৃতি ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়।
(IV) জীবমন্ডল (Biosphere) ঃ
উদ্ভিদ এবং প্রাণী নিয়ে জীবমন্ডল গঠিত। শিলামন্ডলের ওপরে ও বারিমন্ডলের অগভীর অংশে এবং বায়ুমণ্ডলের প্রত্যক্ষ প্রভাবের জীবের সৃষ্টি ও বসবাসের উপযোগী যে সম্বলিত মন্ডল গড়ে উঠেছে তাকে জীবমন্ডল বলে। জীবমন্ডল মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ জীবমন্ডলের উদ্ভিদ ও প্রাণী মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে। উদ্ভিদ ও পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার জীবসম্পদ হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার, জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, বাস্তুতান্ত্রিক উপাদান, মানুষের ও পরিবেশের সাথে জীবমন্ডলের আন্তঃসম্পর্ক প্রভৃতি ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
(গ) মানবীয় ভূগোলের বিষয়বস্তু
মানবীয় ভূগোল ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। মানবীয় ভূগোলের বিষয়বস্তু হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার বন্টন ও ঘনত্ব, জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মানুষের আচার ব্যবহার, ধর্ম, বর্ণ, জীবনধরার পার্থক্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পার্থক্য, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে যে পার্থক্য রয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান, সমীক্ষা করা, এবং এসব বিষয়ের উপর নিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবহার জ্ঞান অর্জন করা মানবীয় ভূগোলের বিষয়বস্তু। আধুনিক যুগের কতিপয় ভূগোলবিদগণ অতি সাধারণভাবে মানবীয় ভূগোলের উপাদান গুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেন। যথা- ১। ভৌগোলিক পরিবেশ ও ২। অপ্রাকৃতিক বা সামাজিক পরিবেশ। এ দু শ্রেণীর উপাদান মানবীয় ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু।
ভূগোলের পরিধি (The Scope of Geography)
ভূগোলের পরিধি ব্যাপক। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রকৃতির যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তাই নিয়েই ভূগোলের পরিধি। আদিম যুগে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো মানুষ তখন থেকেই সে তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে জানার ফলে শুরু হয়েছে ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশ সাধন। সময়ের পরিবর্তনে এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিধি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষের বিজ্ঞানভিত্তিক ভৌগোলিক জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ার সময় থেকে ভূগোল ও বিজ্ঞানের জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভূগোলের পরিধি নিম্নরূপ-
১। পরিবেশের জ্ঞান আহরণ ঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষ সহ সকল প্রাকৃতিক পরিবেশের পারিসরিক গুণবলি বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা করে এবং বিভিন্ন ধাপে ধাপে, সময় ও স্থান অবিরত তার বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ পরিবেশের জটিল সম্পর্ক গুলো বর্ণনা করে।
২। ভূপৃষ্ঠ সম্পর্কে জ্ঞান দান
ভূগোল ভূপৃষ্ঠের নিকটবর্তী পৃথিবীর সবগুলো মন্ডলকে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে একটি মিথস্ক্রিয়াশীল পদ্ধতিতে জ্ঞান দান করার উপর জোর দেয়। অর্থাৎ বিজ্ঞান হিসেবে ভূগোল বায়ু, ভূমি ও পানির নিকটবর্তী জীবমন্ডল সামগ্রিকভাবে জীবমন্ডলের অজৈব ও সজীব সব উপাদান, এদের বৈশিষ্ট্য এবং আন্তঃসম্পর্কগুলো সমীক্ষা করা ভূগোলের পরিধির কাজ।
৩। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ঃ
ভূগোলই অন্যান্য বিজ্ঞানের জননী হিসেবে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে। কারণ ভূগোলবিদগণ একাধারে গঠন কাঠামো-ভূগঠন প্রক্রিয়াসহ বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র, জলবায়ু, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মাটি সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী বলে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে।
৪। পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান দান ঃ
ভূগোল বর্তমানে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভূত্বক, পৃথিবীর উপরিভাগের ভূমিরূপ পরিবর্তনের ও বহিঃশক্তিগুলোর প্রভাবের সৃষ্ট ফল পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।
৫। সৌরজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান ঃ
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বর্তমানে ভূগোলে মহাবিশ্ব, সৌরজগতের গাণিতিক পরিমাপ, অবস্থান, গ্রহের আকার, আয়তন, কক্ষপথ, গতি, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, সময়মন্ডল ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও অনুমিত সিদ্ধান্ত সমূহ বর্ণনা করে। এটি ভূগোল পরিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
৬। পৃথিবী ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় ঃ
পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পৃথিবীর পরিবেশের জন্য শক্তির উৎস হিসাবে সৌরশক্তির বিন্যাস, বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন চক্র ইত্যাদিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভূগোলের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে থাকে।
৭। বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে জ্ঞান দান ঃ
বায়ুমণ্ডলের গঠন, কাঠামো, উপাদান, স্তরবিন্যাস, আবহাওয়া, জলবায়ু এবং উপাদান, তাপমাত্রা, নিয়ামক, বন্টন পদ্ধতি, বিশ্বে এদের প্রভাব সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ভূগোলের পরিধিতে বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা করে।
৮। বারিমন্ডল সম্পর্কে জ্ঞান ঃ
বারিমন্ডল এর উপাদান, সমুদ্রতল দেশ এবং সমুদ্রের বিন্যাস, সমুদ্রের স্রোত, উষ্ণতা, সমুদ্র পানির লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির জোয়ার ভাটা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা ভূগোলের পরিধির আওতাভুক্ত।
৯। বাস্তুতন্ত্র ও জৈবিক প্রক্রিয়া ঃ
প্রাকৃতিক পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র ও জৈবিক প্রক্রিয়া এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলো স্বতন্ত্রভাবে এবং নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে, যাতে মিথস্ক্রিয়া ভূগোলের পরিধির আওতাভুক্ত।
১০। পৃথিবীর উপাদান সম্পর্কে জ্ঞান দান ঃ
বর্তমানে পৃথিবীর যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যেমন-ভূমিরূপ, বায়ুমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল, জীব মন্ডল এবং সৌরজগৎ-এইসব উপাদানের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা তার সবগুলোই সামগ্রিকভাবে ভূগোলের পরিধির ক্ষেত্র রচনা করে।
উপসংহার
আমি এতক্ষণ ধরে ভূগোলের সংজ্ঞা ভূগোলের পরিধি এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে সংক্ষেপে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করেছি। আমি আশা করছি এ বিষয় সংক্রান্ত সঠিক তথ্য পেয়েছেন। এই প্রতিবেদনটি নির্বাচজ্ঞ ও তথ্যবহুল করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেখকের বই এবং রিপোর্ট অনুসন্ধান করা হয়েছে ও সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে যদি কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকে এবং সংযোজন বিয়োজন করার মত তথ্য থেকে থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। এতক্ষণ ধরে এ প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url