অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণীবিভাগ
প্রিয় পাঠক,অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণীবিভাগ আলোচনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাচ্ছেন, এ বিষয়ে সঠিক লেখকের বই খুঁজে পাচ্ছেন না? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন। মনোযোগের সহিত পড়তে থাকুন।
আজকের এই প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সংজ্ঞা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের শ্রেণীবিভাগ, প্রথম পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, চতুর্থ পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পঞ্চম পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভূমিকা
আদিম কালের মানুষ ছিল অত্যন্ত অসহায়। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে মানুষকে বেঁচে থাকতে হতো। যুগ যুগ ধরে নানা বিবর্তন আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বর্তমান মানব সভ্যতা। সভ্যতার এ উন্নতির মূলে রয়েছে মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড। যেমন কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ, পশুপালন, পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, বন্টন, পরিবহন, ব্যাংকিং, বীমা, ডাক্তারি, আইন ব্যবসা প্রভৃতি। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষ তার জীবিকা অর্জন করে থাকে। মানুষ তার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসব কর্মকাণ্ড বা কার্যকরী সম্পাদন করে থাকে তার সমষ্টিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে। বস্তুত মানুষের সেই সকল কার্যাবলীই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যা অর্থ বা আর্থিক মূল্য তারা নিরূপণ করা সম্ভব।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সংজ্ঞা ( Definition of Economic Activities )
মানুষ তার প্রতিদিনের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসব কর্মকান্ড করে তাকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা অর্থনৈতিক ক্রিয়া কালাপ বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে, মানুষ যেসব কার্যাবলীর সম্পাদন করে ক্রিয়াকালাপ অর্থ আয় করে সংসার নির্বাহ করে তাকে অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে। যেমন কৃষিকাজ, মৎস্য শিকার, পশুপালন, শিল্প-কারখানা, শ্রমদান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কুলিগিরি ইত্যাদি। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মূলত বিশ লক্ষ বছরের পুরানো। বিভিন্ন অর্থনীতি ও ভূগোলবিদ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে কয়েকটি সংগা উল্লেখ করা হলো-
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, "পণ্য সামগ্রী ও সেবার উৎপাদন, বিনিময় এবং ব্যবহারের সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোন মানবীয় আচরণের প্রকাশই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।"
টি ডব্লিউ আলেকজান্ডার এর মতে," পৃথিবীর পৃষ্ঠে কোন কিছুর উৎপাদন, বিনিময়ে এবং ভোগ বা ব্যবহারের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।"
অধ্যাপক থমাস এর মতে," উৎপাদন ভোগ ও বন্টন জনিত কর্মকাণ্ডকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে।"
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভূগোলবিদ ডক্টর কাজী আব্দুর রউফ এর মতে, "মানুষের যেসব কাজ নিজের পরিবারের সমাজের, দেশের এবং সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর আর্থিক উন্নতি ও ধন সম্পদ লাভের সাথে সম্পর্ক বিশিষ্ট সেই কাজগুলোকে অর্থনৈতিক কার্যাবলী বলে।"
প্রখ্যাত ভূগোলবিদ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর মতে," মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার নিমিত্তে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে কার্যকলাপ সম্পাদন করে তাদের সমষ্টিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা কার্যাবলী বলে।"
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যেসব কার্যকালের সম্পাদন করে তাদের সমষ্টিকে অর্থনৈতিক কার্যাবলী বা কর্মকান্ড বলে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য (Charectarestics of Economic Activities )
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
১। ব্যয়বহুলতা (Costly) ঃ
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ব্যয়বহুলতা। কারণ এর উৎপাদন ব্যয় রয়েছে। ব্যয়হীন ও ব্যয় সাপেক্ষ নয় এমন কিছু বিষয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য হবে না। যেমন দানসামগ্রী বা দানপত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়।
২। বিনিময় যোগ্যতা (Exchangeability) ঃ
কোন কিছুর পরিবর্তে অন্য কিছু পাওয়ার ব্যবস্থাকে বিনিময় বলে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিময় বলতে বাজার প্রাপ্তির যোগ্যতাকে বোঝানো হয়েছে। বাজারে পাওয়া যায় না এমন কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচ্য হবে না। যেমন কোন বিশিষ্ট শিল্পকর্ম, হস্তশিল্প, প্রভৃতি অর্থনৈতিক পণ্য নয়।
৩। মূল্যযোগ্যতা (Having price) ঃ
বিনিময়ের আর্থিক মানকে সাধারণভাবে মূল্য বলা হয়। এক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহ পরিচিতি মূল্য নির্ধারণের মৌলিক প্রভাবক পরিস্থিতি অনুযায়ী মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূল্যযোগ্যতা। অর্থাৎ বাজারের অবস্থা অনুযায়ী এর মূল্যমানের পরিবর্তন হয়।
৪। স্থানান্তরযোগ্যতা (Transferability) ঃ
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পণ্যের স্থানান্তর যোগ্যতা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক পণ্যের স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিবহন করা যায়। অবশ্যই স্থাবর বস্তু যেমন জমিজমা, অট্টালিকা, পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ভৌতভাবে স্থানান্তর যোগ্য না হলেও এগুলোর মালিকানার ও ব্যক্তিগত পরিবর্তন হতে পারে। ফলে এগুলো অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে।
৫। নিয়ন্ত্রণযোগ্যতা (Controllable) ঃ
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নিয়ন্ত্রণযোগ্যতা। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের ওপর ধার্য কর হ্রাস-বৃদ্ধি এমনকি বন্ধও করা যায়। কর হ্রাস, ভর্তুকি প্রদান করে পণ্যের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি করা যায়, তেমনি কর আরোপ ও ভর্তুকি প্রত্যাহার করে কোন পণ্যের উৎপাদন হাস করা যায়।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Economic Activities)
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এজন্য মানুষের শিক্ষা, দক্ষতা ও মেধার উন্নয়নের সাথে সাথে জীবন যাত্রার মানেরও পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এ কারণে বিভিন্ন ভূগোলবিদ স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে শ্রেণী বিভাজন করেছেন। যেমন-
ভূগোলবিদ Harold H. Mclerty ও G.B. Lindbery অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মোট দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন. যথা-
১। উৎপাদনমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Production Activities) এবং
২। ভোগমূলক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Consumption Activities).
আবার T. A. Hartshon ও T.W. Alexander তাদের Economic Geigraohy গ্রন্থে প্রধানত তিন প্রকারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কথা বলেছেন. যথা-
১। উৎপাদন (Production) ঃ
উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে পাঁচটি উপ-বিভাগ করেছেন. যথা-
(I) প্রথম পর্যায়ের কর্মকাণ্ড (Primary activities),
(II) দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ড (Secondary activities),
(III) তৃতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ড (Tertiary activities),
(IV) চতুর্থ পর্যায়ের কর্মকাণ্ড (Quaternary activities),
(V) পঞ্চম পর্যায়ের কর্মকাণ্ড (Quinary activities).
২। বিনিময় (Exchange) এবং
৩। ভোগ (Consumption).
অন্যদিকে, প্রখ্যাত ভূগোলবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার 'অর্থনৈতিক ভূগোল' গ্রন্থে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে কর্মকান্ডকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-
১। প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Primary Economic activities),
২। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Secondary Economic activities) এবং
৩। তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Tertiary Economic activities).
তবে মানুষের চাহিদা আকাঙ্ক্ষা পণ্যের আকার ও সেবারধরন অনুসারে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১। প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Primary Economic activities),
২। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Secondary Economic activities),
৩। তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Tertiary Economic activities).
৪। চতুর্থ পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Quaternary Economic activities) এবং
৫। পঞ্চম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Quinary Economic activities).
১। প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Primary Economic activities) ঃ
এই পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সরাসরি প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ সরাসরি প্রকৃতির সাথে যেসব কাজে লিপ্ত থাকে সেগুলোকে প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে। যেমন-খাদ্যশস্য উৎপাদন, পশু শিকার, খনিজ সম্পদ, উত্তোলন, পশুপালন, কাঠ সংগ্রহ, কাঠ চেরাই, মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ ইত্যাদি। আদিম যুগের মানুষ ছিল বর্বর ও অসহায় এবং প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
তখন মানুষ ফলমূল সংগ্রহ এবং পশু ও মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ নিত্যনতুন চাহিদা অনুভব করে এবং জীবনধারণ প্রণালীতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। মানুষ প্রকৃতিতে অনুসরণ ও অনুকরণ করে কৃষি কাজের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে। প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের সমষ্টিগতভাবে Red Coller Worker হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য ঃ
নিচে প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য সমূহ তুলে ধরা হলো-
- প্রাথমিক পর্যায়ের পণ্য সমূহ সরাসরি প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত হয়।
- অনুন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়।
- মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই এই কর্মকান্ডের প্রধান উদ্দেশ্য।
- এ ধরনের কর্মকাণ্ড সাধারণত প্রকৃতির উপর অধিক পরিমাণে নির্ভরশীল।
- এ কর্মকান্ডের মূলভিত্তি হচ্ছে ভূমি ও শ্রম।
- এ পর্যায়ের কর্মকাণ্ড গ্রাম ভিত্তিক।
- এ ধরনের কর্মকাণ্ড সনাতন পদ্ধতিতে হয় বলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই অনুন্নত।
- পৃথিবীর অধিক সংখ্যক মানুষ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছে।
প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্রেণীবিভাগ ঃ
প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রধানত সাতটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। আদিম সংগ্রহকারী (Primitive gathering) ঃ
আদিমকাল থেকেই মানুষ নিজেদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য হিসেবে সংগ্রহ করত বনের ফলমূল, বস্ত্রের জন্য সংগ্রহ করত গাছের ছাল ও পাতা, এবং বাসস্থানের জন্য সংগ্রহ করত গাছের ডালপালা।
২। পশুশিকার (Hunting) ঃ
প্রাচীনতম পেশা গুলোর মধ্যে পশুশিকার একটি অন্যতম পেশা। পশু শিকার বলতে পশু এবং পাখির উভয়কেই ফাঁদ বা ধারালো অস্ত্রের দ্বারা আঘাত করে শিকার করা বোঝায় মানব সভ্যতার বহু পূর্ব থেকে মানুষ বন জঙ্গলে প্রবেশ করে পশুপাখি শিকার করত। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তন্দ্রা অঞ্চলে হরিণ, সেট শ্বেতভাল্লুক, শৃগাল, কুকুর, সাপ ও বিভিন্ন ধরনের পাখি শিকার করত। এসব পশুপাখি আদিম অধিবাসীরা তীর, ধনুক, প্রকৃতির সাহায্যের শিকার করে এদের মাংস ভক্ষণ করে।
৩। কাঠ সংগ্রহ (Lumbering) ঃ
বেঁচে থাকার তাগিদে পূর্বে মানুষ আফ্রিকা, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সরলবর্গীয় বনভূমি থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঠ সংগ্রহ করত। প্রথম থেকে এসব কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় তার ব্যবহার হতো।
৪। মৎস্য শিকার (Fishing) ঃ
আদিম কাল থেকে মৎস্য শিকার ও মৎস্য ব্যবসায়ীকে মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। সাগর, নদী, খালবিল, পুকুর, হাওর প্রভৃতি উৎস থেকে মৎস্য আহরণ করা হয়। যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশের উপকূলবর্তী মানুষের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মৎস্য শিকার।
৫। খনিজ উত্তোলন (Mining) ঃ
প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকান্ড হিসেবে ভূগর্ভ থেকে খনিজদ্রব্য আহরণ করে বহু মানুষ জীবিকা অর্জন করে। কয়লা, খনিজ তেল, আকরিক লোহা, অ্যালুমিনিয়াম,দস্তা, নিকেল, গন্ধক, টিন প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ গুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু লোক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকে।
৬। পশুপালন (Animal keeping) ঃ
কৃষি কাজের পূর্বেই শুরু হয়। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকতো। অরণ্যচারী মানুষ তখন খাদ্যের সন্ধানে অরণ্যের পশু পক্ষি শিকার করত। সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ অরণ্যচারী জীবন পরিত্যাগ করে পশুকে পোষ মানিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, পোশাক, কৃষি, শেচ ব্যবস্থা ও পরিবহন কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। একে পশুচারণ বা পশু পালন বলে। প্রথম অবস্থায় মানুষ শুধু জীবিকার উদ্দেশ্যে পশু পালন করতো। কিন্তু বর্তমানে সভ্য সময়ে মানুষ প্রধানত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই পশুপালন বা পশুচারণ করে থাকে।
৭। কৃষিকাজ (Agriculture) ঃ
মানুষের প্রাচীনতম এবং প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে কৃষি অন্যতম। কৃষির উৎপত্তি এবং ব্যাপ্তি অতি প্রাচীন। ধারনা করা হয় যে, প্রায় ২০ হাজার বছর পূর্বে কৃষির উদ্ভব ঘটেছিল। তখন কৃষিই ছিল মানুষের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়। জলবায়ু ও মৃত্তিকার তারতম্যের জন্য পৃথিবীর সর্বত্র কৃষির স্বরূপ এক নয়। পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ বা অঞ্চল রয়েছে যে দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কৃষিকে প্রধান অবলম্বনে হিসাবে ভাবা হয়।
২। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Secondary Economic activities) ঃ
প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকান্ড থেকে উৎপাদিত গঠন ও আকার গত পরিবর্তন সাধন করে তার উপযোগিতা সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে। যেমন-ধান থেকে চাল, বনভূমির সংগ্রহীত কাঠ থেকে কাগজ ও বিভিন্ন প্রকার বোর্ড তৈরি, তুলা থেকে সুতা, কাপড়, জামা এবং পাট হতে চট, সুতলি, বস্তা ইত্যাদি তৈরি। আবার খনি হতে প্রাপ্ত পাতলা আকরিক লোহার রড পরিবর্তন করে ঢালাই লোহা, পেরেক, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি তৈরি। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের সমষ্টিগতভাবে Blue Coller Worker হিসেবে অভিহিত করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য ঃ
দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকান্ডে প্রথম পর্যায়ের উৎপাদিত দ্রব্যসমূহ কে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অধিকতর নবায়নযোগ্য করা হয়।
- এ ধরনের কর্মকাণ্ড শহর বা নগরভিত্তিক গড়ে ওঠে।
- এর কর্মকান্ডের মূলধন ও উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা অন্যতম উপাদান।
- এ কর্মকান্ডে ভূমির ব্যবহার কম হয়।
- এ কর্মকান্ডে অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়।
- এ কর্মকান্ডে সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি করে, উপযোগিতা বৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো হচ্ছে ঃ
- লৌহ ও ইস্পাত শিল্প।
- বয়ন শিল্প ( কার্পাস বয়য়ান, শিল্প রেশম বয়ান শিল্প )।
- সিমেন্ট শিল্প।
- অ্যালুমিনিয়াম শিল্প।
- কাগজ শিল্প।
- ঔষধ শিল্প এবং
- রাসায়নিক শিল্প।
৩। তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Tertiary Economic activities) ঃ
কোন প্রকার উৎপাদন না করে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ড হতে প্রাপ্ত বস্তুসমূহের উপযোগিতা বৃদ্ধি করাকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকান্ডের ফলে উৎপাদিত দ্রব্যসমূহ পরিবহন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে উপযোগিতা বৃদ্ধি করার কাজকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে। তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকান্ড এর উপর নির্ভরশীল।কোন দেশের উৎপাদিত সামগ্রীর উদ্বৃত্তাংশ ঘাটতি অঞ্চল সমূহে প্রেরণ করলে ওই বস্তুর কার্যউপযোগিতা বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এটা সম্ভবপর হতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবহনের মাধ্যমে। কাজেই পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য, পণ্য সামগ্রী আদান-প্রদানের জন্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীকে সমষ্টিগতভাবে Pink Coller Worker নামে অভিহিত করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য সমূহ ঃ
- এ কর্মকান্ডের মাত্রা নির্ভর করে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পণ্য দ্রব্যের উৎপাদনের ওপর।
- এ কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত।
- এ পর্যায়ের কর্মকাণ্ড বাজার নির্ভর হয়ে থাকে।
- এ পর্যায়ের কর্মকান্ড বাণিজ্য প্রসার ঘটায়। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
- এ পর্যায়ের কর্মকান্ড পণ্যের মানের উপর নির্ভরশীল।
- এ পর্যায়ে কর্মকাণ্ড উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে।
- বাণিজ্যিক পণ্য সামগ্রী আদান-প্রদানের জন্য উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা একান্ত জরুরী।
তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গুলো হচ্ছে-
- বিনোদন।
- ব্যক্তিগত বৃত্তি।
- চিকিৎসা।
- ব্যক্তিগত সেবা।
- সরকারি প্রশাসন।
- বাণিজ্য ও মেরামত সেবা।
- খুচরা বাণিজ্য।
- পাইকারি বাণিজ্য।
- পরিবহন ও যোগাযোগ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা।
৪। চতুর্থ পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Quaternary Economic activities) ঃ
এ পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে সেবামূলক কার্যক্রমই বেশি দেখা যায়। এ সেবামূলক কাজের মধ্যে বৃত্তিমূলক, প্রশাসনিক ও বিনোদনমূলক সেবা কর্ম অন্তর্ভুক্ত। বৃত্তিমূলক সেবা কর্মের মধ্যে ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ওকালতি, সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ধোপা, নাপিত, ব্যাংকার, নৌকার মাঝি প্রভৃতি পেশার লোক অন্যতম।এ পেশার লোক সেবা কাজের মধ্যে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রশাসনিক সেবাকর্মের মধ্যে সরকার প্রধান ও দেশের বিভিন্ন বিভাগের সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা ও নির্বাহী কর্মকর্তা যেমন-রাষ্ট্রপতি, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, চিফ এক্সিকিউটিভ প্রভৃতি অন্যতম। বিনোদনমূলক সেবার মধ্যে শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা, নাটক, সার্কাস প্রভৃতি অন্যতম। চতুর্থ পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিতদের সমষ্টিগতভাবে White Coller Worker বলা হয়।
চতুর্থ পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য সমূহ ঃ
- এ পর্যায়ে কর্মকাণ্ড মূলধনমুখী হলেও মূলত সেবামূলক।
- এ পর্যায়ে কর্মকাণ্ড শহর ও নগরমুখী।
- এ পর্যায়ে উন্নত চিন্তাধারা কে সামনে রেখে দেশ পরিচালনা করা হয়।
- এ কর্মকান্ডের উপর ভিত্তি করেই কোন দেশের উন্নতির পরিমাপ ও অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
৫। পঞ্চম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড (Quinary Economic activities) ঃ
বর্তমান সময়ের উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা সেবা, কনসালটেন্সি সার্ভিস, বিনোদন, উচ্চতর গবেষণা, উপগ্রহ পরিষেবা ও জিআইএস সংক্রান্ত কাজ লক্ষ্য করা যায়। এসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কে অনেকে পঞ্চম পর্যায়ের আধুনিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ পর্যায়ে কর্মকান্ডে জড়িতদের Gold Coller Worker হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।মন্তব্য,
আজকের এই প্রতিবেদনে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের অর্থনৈতিক ভূগোল বিষয়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কি বা এর সংজ্ঞা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের শ্রেণীবিভাগ গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এই বিষয়ে সঠিক এবং পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের এই প্রতিবেদনে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের অর্থনৈতিক ভূগোল বিষয়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কি বা এর সংজ্ঞা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের শ্রেণীবিভাগ গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এই বিষয়ে সঠিক এবং পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url