জিআইএস কি জিআইএস এর প্রয়োজনীয়তা বা ভূগোলে GIS এর ব্যবহার

প্রিয় পাঠক, আপনি জিআইএস কি জিআইএস এর প্রয়োজনীয়তা বা ভূগোলে জিআইএস এর ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য জানতে চাচ্ছেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক ঘাটাঘাঁটি করছেন, মনমত বা নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

জিআইএস কি জিআইএস এর প্রয়োজনীয়তা বা ভূগোলে GIS এর ব্যবহার

আজকের এই প্রতিবেদনে জিআইএস কি, এর সংজ্ঞা, এর প্রয়োজনীয়তা এবং ভূগোলে জিআইএস এর ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। চলুন বিস্তারিত তথ্যগুলো দেখে নিন।

ভূমিকা

জিআইএস (GIS) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সিস্টেম (Geographic Information System) বা ভৌগোলিক তথ্য পদ্ধতি। খুব সংক্ষিপ্ত অর্থে ভূগোল হচ্ছে 'পৃথিবীর বর্ণনা' আর ভৌগোলিক তথ্য বলতেও ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত যাবতীয় বস্তু সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যাবলী কে বুঝায়। সাধারণভাবে GIS বলতে একটি তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে বোঝায় যার মাধ্যমে কম্পিউটার প্রযুক্তির সহায়তায় পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সংযোজন, বিশ্লেষণ, প্রদর্শন প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

জিআইএস (GIS) কি বা এর সংজ্ঞা

জিআইএস (GIS) শব্দের অর্থ ভৌগোলিক তথ্য ও পদ্ধতি (Geographic Information System)। ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানিক ও অবস্থানিক উপাত্তের সমন্বয় ঘটিয়ে কম্পিউটারের সাহায্যে বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ, সংরক্ষণ,সমন্বয়ন, উপস্থাপন প্রভৃতি কাজগুলো যে প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হয় তাকেই মূলত জিআইএস (GIS) বলে। নিম্নে জিআইএস এর প্রচলিত কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-

D.W Rhind (1989) G.I.S এর সংজ্ঞায় বলেন, "G.I.S is computer system that can hold use data describing places on the Earth's surface" ( জিআইএস হচ্ছে একটি কম্পিউটার পদ্ধতি যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানের উপাত্ত ধারণ ও ব্যবহারের বর্ণনা দেয় )।

P.A Burrough (1986)- এর মতে, GIS হল, A set of tools for collecting storing, retrieving a will transforming and displaying spatial data from the real world for particular set of purpose.

A Modern Dictionary of Geography-তে প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী GIS হচ্ছে "A store of geographical data held in digital form on a computer."

সুতরাং উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোতে যে সাধারণ বিষয় উঠে আসে তা হলো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কম্পিউটার সিস্টেমের সাহায্যে পরিচালিত বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভৌগোলিক তথ্য বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের কৌশল কে G.I.S বলে।

জি.আই.এস এর প্রয়োজনীয়তা বা ভূগোলে GIS এর ব্যবহার 

ভূগোল একটি প্রাচীন গ্রন্থ হলেও ভূগোলের বিভিন্ন শাখাগুলোতে জিআইএস প্রযুক্তি জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করে ভূগোলকে আধুনিক ভূগোলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ভূগোলের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নে ভূগোলের বিভিন্ন শাখায় জিআইএস এর ব্যবহার বর্ণনা দেওয়া হল-

১। ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় GIS :

জিআইএস ব্যবহারের মাধ্যমে মৌজা মানচিত্র ডিজিটাইজ করা এবং ডাটাবেজ থেকে ভূমি ব্যবহার মানচিত্র তৈরি করা হলে ভূমি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুণাবলীর একটি সচিত্র পাওয়া যায়। এভাবে ভূমির রেকর্ড, ভূমির খাজনা আদায়, ভূমির দাগ নম্বর, খতিয়ান ও নকশা তৈরীর ক্ষেত্রে আমরা জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি। এছাড়া মৃত্তিকার গুনাগুন, উর্বরতা শক্তির বৃদ্ধি, নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে মানচিত্র অংকন করে সঠিকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। সমাজে জমির মালিকানা নিয়ে প্রায়ই যে জটিলতা সৃষ্টি হয় তার সমাধান করা সম্ভব হবে।

২। আধুনিক নগর গড়ে তোলায় GIS :

একটি আধুনিক নগর গড়ে তুলতে এবং ঐ নগরের আধুনিক নাগরিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা ও পরিকল্পিত নগরায়ন আবশ্যক। যেকোন দেশের নগরের নকশা ও জমির প্লট তৈরি পরিকল্পনার জন্য পরিকল্পিতভাবে রাস্তা কালভার্ট পানি সরবরাহের লাইন বিদ্যুৎ লাইন পানি নিষ্কাশন ও পয়ঃপ্রণালীর জন্য ড্রেন ব্যবস্থা করতে হয়। এ সমস্ত প্রকল্প প্রণয়ন এবং নিখুঁত নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার জন্য জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে মানচিত্র অঙ্কন করে, সহজে ঐ সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করা সম্ভব।

৩। খনিজ সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহারে GIS :

একটি দেশের কোন অঞ্চলে কি কি খনিজ সম্পদ আছে এবং ঐ সকল সম্পদ কি পরিমানে মজুদ আছে তা জিআইএস ব্যবহার করে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে ডাটাবেজ তৈরি করে মানচিত্রে অঙ্কন করা সম্ভব। এতে করে সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী খনিজের ধরন অনুসারে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।

৪। বনজ সম্পদ আহরণ এবং উন্নয়নে GIS :

একজন অর্থনীতিবিদদের ভাষায় একটি দেশের তার মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকলে সেই দেশে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারবে। আবার একটি দেশে অনেক বনভূমির অবস্থা যেখানে পায়ে হেঁটে সেখানে জরিপ করা অসম্ভব। একটি দেশের পাহাড়িয়া বনভূমি, ম্যানগ্রেভ বনভূমি, নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের বনভূমি যা জরিপ করা আহরণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।


আবার এসব বনভূমিতে যদি আগুন লাগে কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন এ বনভূমি রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করা হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে আমরা দূর অনুধাবন কলাকৌশল দ্বারা প্রাপ্ত ছবি জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ইমেজ এনালাইসিস করে অতি সহজে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে পারি।

৫। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় GIS :

একটি দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে না পারলে সে দেশের অর্থনীতি উন্নতি করা যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার, শিল্প ব্যবস্থার প্রসার এবং সর্বোপরি যুব সমাজকে কাজে লাগাতে হলে দেশের একটি সুসম যোগাযোগ ব্যবস্থা আবশ্যক। একটি দেশের কতটি মহাসড়ক, কতটি পাকা রাস্তা, কতটি কাঁচা রাস্তা,স্থলবন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং এগুলোর পরস্পর দূরত্ব প্রভৃতি তার ডাটাবেজ জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে নিখুঁত ও নির্ভুল একটি মানচিত্র থাকতে হবে। 

অতঃপর যানবাহন শ্রেণীকরণে প্রতিটি সড়কের টোল ধার্য, ফেরি পারাপারে টোল ধার্য প্রভৃতির তথ্য উপাত্ত জিআইএস প্রযুক্তিতে সংরক্ষণ ও উপস্থাপন-এর মাধ্যমে তৈরি রাখতে হবে। উল্লেখিত বিষয়গুলো অতি সহজে জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা করে তোলা সম্ভব।

৬। ভৌগোলিক গবেষণায় GIS :

ভৌগোলিক জ্ঞানচর্চার জন্য কোন অঞ্চলের প্রাকৃতিক অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য জিআইএস প্রযুক্তির উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জলবদ্ধতা অঞ্চল কিভাবে, কি কাজের আওতায় আনা যায়, না সেখানে মাছ চাষ সম্ভবপর এ বিষয়ে গবেষণার জন্য জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা যায়। এ উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম জলবদ্ধতার এলাকার স্থায়িত্ব কতদিন ধরে এবং এখানকার মাটির গুনাগুন প্রভৃতি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরি এবং এ থেকে মানচিত্র অঙ্কন করে দলবদ্ধতা অঞ্চলটির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা সম্ভব।

৭। দুর্যোগ মোকাবেলায় GIS :

বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছর পৃথিবীর কোন না কোন অঞ্চলে যান এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। যেমন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, সুনামি, জলবদ্ধতা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমাদের বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। দেশের দুর্যোগ প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। অঞ্চলভেদে ক্ষয়ক্ষতির, প্রাণহানির মাত্রা নিরূপণ করতে হয়। 

তারপর ঐ অঞ্চলের অতীত অবস্থার সাথে বর্তমান অবস্থা সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করতে হবে। তারপর, ঐ মানচিত্র অঙ্কন দুর্যোগ মোকাবেলার করণীয় পন্থাসমূহ প্রভৃতি কার্যাবলী জিআইএস প্রযুক্তিতে ব্যবহার করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ব্যাপকভাবে GIS প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

৮। পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় GIS :

বর্তমান পৃথিবীতে পানি সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন দেশ সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি এবং নাগরিক জীবনে পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি প্রবাহের নকশা তৈরি, বৃষ্টির পানি ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে জলাধার নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন। ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তরের মডেল তৈরি, জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার মানচিত্র অংকন, জলবদ্ধতা এলাকা চিহ্নিতকরণ ও মডেল তৈরি প্রভৃতি কার্যবলিতে GIS প্রযুক্তির উদ্দেশ্যে অতি সাফল্যের ও সুনামের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৯। ভূমিরূপ বিদ্যায় GIS :

ভূমিরূপবিদ্যার বিষয়বস্তু পাহাড় পর্বত মালভূমির সমভূমি জলাভূমি ভূমির বন্ধুরতা, প্রভৃতি প্রাকৃতিক অবয়বগুলো জিআইএস এর মাধ্যমে একটি মডেল তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ ও পঠনে হাতে-কলমে বিদ্যা দান করা যায়।

১০। জলবায়ু বিদ্যায় GIS :

জিআইএস প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিদিনের আবহাওয়ার পরিবর্তনের অবস্থা, জলবায়ুর পরিবর্তন, বিশ্লেষণ এবং জলবায়ু আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করা যায়।


১১। কৃষি ভূগোলে GIS :

জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৃত্তিকার গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে ফসল নির্বাচন করা হয়। কৃষি খামার পর্যবেক্ষণ ভূমিক্ষয়, শস্যাবর্তন, দুর্যোগের ফলে ফসলের কি পরিমান ক্ষতি হয় তা নিরূপণ করা সম্ভব। কৃষি মানচিত্র, কৃষি ভূমি ব্যবহারের মানচিত্র, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার মানচিত্র প্রভৃতি GIS প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্ভুল মানচিত্র অংকন করা যায়।

১২। পরিবেশ রক্ষায় GIS :

জিআইএস ব্যবহারের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের শিল্প-কারখানা, মোটর গাড়ির ধোঁয়া, খরা, লবণাক্ততা, প্রভৃতি পরিবেশের কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে তা চিহ্নিত করে ক্ষতিকারক বিষয়গুলো প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। তাছাড়া যদি জনবসতির কারণে কৃষিজমি, বনভূমি যদি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাহলে জনবসতি স্থাপন রোধ করতে হবে। এভাবে GIS প্রযুক্তি দ্বারা পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে।

মন্তব্য

পরিশেষে বলা যায় যে, আমরা এতক্ষণ ধরে জিআইএস কি GIS এর প্রয়োজনীয়তা এবং ভূগোলে এর ব্যবহার সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য তুলে ধরেছি, আশা করছি এই বিষয়ে পুরোপুরি ধারণা পেয়েছেন। এই প্রতিবেদন সম্পর্কে যদি কোন মন্তব্য থেকে থাকে তাহলে নিচে কমেন্টস বক্সে জানিয়ে রাখবেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url