মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক সমূহ বিস্তারিত আলোচনা
প্রিয় পাঠক, মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক সমূহ বিস্তারিত আলোচনা জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক এবং ওয়েবসাইট ভিজিট করছেন? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন। এর প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন তাহলে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।
আজকের এই প্রতিবেদনে মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক , শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ কাল, পশু গার্হস্থ্যকরণ ও পশুচারণ কাল, উদ্ভিদ গার্হস্থ্যকরণ ও কৃষি অনুশীলন কাল, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও শিল্পায়নের কাল সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে।
ভূমিকা
মানুষের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক কি তা খুঁজে বের করার ইতিহাস ভৌগোলিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার শুরু থেকেই। প্রাচীনকাল থেকেই মনীষীগণ অনুসন্ধান করতে থাকেন প্রকৃতির সাথে মানুষের বিদ্যমান সম্পর্ক। গ্রীক সভ্যতা ও রোমান সভ্যতার সময় হতেই মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিবেশে মানুষের স্থান কোথায় তা নিয়েই যুগের পর যুগ ধরে অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা চলতে থাকে। মধ্যযুগের সূচনাতে এবং বুনিয়াদি যুগে মানুষ প্রকৃতির হাতে ক্রীড়নক এই ধারণাটি প্রধান লাভ করে।
প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডারউইন ও তার বিখ্যাত বিবর্তনবাদ সম্পর্কে প্রকৃতির প্রভাবের কথা প্রথম ব্যক্ত করেন। ফলে বিবর্তনবাদ প্রতিবেদনটি ভূগোল গ্রন্থে এবং ভূগোলবিদদের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই সময় হতে ভূগোলবিদ গণ ও অন্যান্য মনীষীগণ পরিবেশ সম্পর্কে বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের করার কিছুই নেই, মানুষ পরিবেশের হাতে ক্রীড়নক। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিত্তি করে পরিবেশিক নিমিত্তবাদ দর্শনের ধারণার উন্মেষ ঘটে।
মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক (Relation Between Man and Environment)
পরিবেশের জৈবিক উপাদান গুলোর মধ্যে মানুষ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং একই সাথে সে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ও। সুতরাং 'জৈবিক' বা 'দৈহিক/প্রাকৃতিক মানুষ', সামাজিক মানুষ, অর্থনৈতিক মানুষ এবং প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিভিন্ন সক্ষমতার প্রাকৃতিক পরিবেশ পদ্ধতিতে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিজ্ঞান ও শিল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষও পরিবেশের সম্পর্ক ও পরিবর্তিত হচ্ছে, অবশ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে খুব বেশি উন্নতি সাধন করতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের ' প্রাকৃতিক মানুষ' এর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে উত্তম ও প্রাকৃতিক। কিন্তু বর্তমানের 'প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক বহুলাংশে বৈরীভাবাপন্ন।প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত মানুষ ও পরিবেশের বিবর্তন ধারা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের কাল (Period of Hunting & Gathering)
২। পশু গার্হস্থ্যকরণ ও পশুচারণ কাল (Period of Animal Domestication & Pastoralism)
৩। উদ্ভিদ গার্হস্থ্যকরণ ও কৃষি অনুশীলন কাল (Period of Piant Domestication & Agriculture)
৪। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পায়নের কাল (Period of Science Technology & Industrialization )
১। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের কাল (Period of Hunting & Gathering)
প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ পরিবেশেরই একটি অংশ ছিল। বন্য সব প্রাণীদের মতই তার আচরণ ছিল। সে সময়ে মানুষের একমাত্র প্রয়োজন ছিল খাদ্য এবং তা সে নিজের পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করত। এজন্য সে সময়ের মানুষকে প্রাকৃতিক মানুষ বলা হতো। সে সময় মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য ফলমূল আহার করত, আশ্রয়ের জন্য গাছের কোটর বা পাহাড়ের গুহা ব্যবহার করত। ফলে পরিবেশের সাথে তার আন্তরিক মধুর ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বর্তমান ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করতে বলে মানুষ সম্পূর্ণভাবে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল ছিল। খাদ্য আশ্রয় প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করলেও মানুষ প্রকৃতির ওপর তেমন বিরূপ কোন প্রভাব সৃষ্টি করত না।
আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে যে হিংস্র পশুগুকে পাথরের আঘাতে মেরে ফেলত তার মাংস ও এরা সবাই আগুনে ঝলসে নিয়ে পুড়িয়ে ভাগ করে খেয়েছে। মানুষ পরিবেশ থেকে সম্পদ শোষণ বা আহরণ করতে শুরু করলো। সে সময় মানুষের সংখ্যা কম থাকায় পশু শিকারের সংখ্যাও ছিল কম এবং এর ফলে পরিবেশের উপর তেমন কোন বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেনি। খাদ্যদ্রব্য রান্না করার কৌশল যখন মানুষ আয়ত্ত করল তখন থেকে জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ ও জঙ্গল কাটা শুরু করলো। মাংস টুকরা করতে বা কাঠ কাটতো অস্ত্র ব্যবহার শুরু হওয়ায় মানুষের প্রযুক্তি আর একধাপ এগিয়ে গেল।
২। পশু গার্হস্থ্যকরণ ও পশুচারণ কাল (Period of Animal Domestication & Pastoralism)
বন থেকে পশু স্বীকার করতে গিয়ে মানুষ বড় পশু মেরে ফেললেও পশু শাবকগুলো কৌশলে ধরে নিজেদের বসতি এলাকায় নিয়ে আসতো। মেয়েদের ও ছোট ছেলে মেয়েদের যত্নে ও আদরে লালিত পশু শাবক ক্রমে বড় হতো। ধীরে ধীরে এদের সংখ্যা বেশি হতে লাগলো। যাযাবর পশু পালনকে অনুসরণ করে তৃণের চাষ করে খামারে পশু পালনের ব্যবস্থা করা হলো। সময়ের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পশু পালকদেরকে দুধ সংরক্ষণ, মাখন, পনির, ঘি প্রভৃতি তৈরি করতে হলো। ক্রমে দুগ্ধ দূরবর্তীপরবর্তী শহর-নগর শিল্প এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোতে কোটাজাত মাখন, পনির, ঘি প্রভৃতি সরবারহের ব্যবস্থা করা হলো।
D.B. Botkin, S E.A.Keller, ১৯৮২ এর মতে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা নিম্নে বর্ণিত সাতটি পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবেশের পরিবর্তন সাধন করতো-
(I) খাদ্যের জন্য পশু শিকার,
(II) শিকারের মাধ্যমে কোন কোন পশুর প্রাচুর্যতা হ্রাস,
(III) কোন কোন পশুর আবাসনের পরিবর্তন সাধন করে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ওইসব প্রজাতির জন্য আবাসন গুলো অনেক অনুকূল করে তুলেছিল,
(IV) পালিত পশুর চলাচল সহজতর এবং নিজের ও পশুগুলোর জন্য ঘর তৈরি করার জন্য বনভূমি পুড়িয়ে ফেলা হতো,
(V) উদ্ভিদ ও পশুগুলো গার্হস্থ্যকরনের মাধ্যমে,
(VI) কৃষি অনুশীলন ও অন্যান্যভাবে ভূমি পরিষ্কার করে এবং মাটি ও উদ্ভিদের পরিবর্তন সাধন করে ক্ষীয়ভবনের হার পরিবর্তন করা হতো,
(VII) নতুন জায়গায় বিভিন্ন জীবের স্থানান্তরের মাধ্যমে সেগুলোকে ভৌগলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো,
৩। উদ্ভিদ গার্হস্থ্যকরণ ও কৃষি অনুশীলন কাল (Period of Piant Domestication & Agriculture)
প্রাকৃতিক পরিবেশিক প্রণালীর বা বাস্তুতন্ত্রের গঠন জৈবিক উপাদান পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণে মানব পারদর্শিতার বিকাশের ক্ষেত্রে খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের গার্হস্থ্যকরণ একটি উৎকর্ষতা নির্দেশক ছাপ। উদ্ভিদের গার্হস্থ্যকরনের পরে কৃষির আদিম শ্রেণীর এবং ইতিপূর্বের যাযাবর ও ভ্রাম্যমান মানুষদের স্থিতিশীল বসতি প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু তবুও সে সময় অনেক মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করতো।
কৃষি কাজের জন্য পানি ও উর্বরভূমি সহজলভ্য হওয়ায় অধিকাংশ লোক নদী উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল। কৃষির উদ্ভব ফসল বিক্রির বা বিনিময়ের ফলাফল হিসেবে ঘরবাড়ির উন্নতি, গ্রাম-শহর-নগর স্থাপন, বাণিজ্য কেন্দ্র, গঞ্জ এলাকা, ছোট বড় সেতু নির্মাণ, স্কুল-কলেজে স্থাপন ও শিক্ষার বিস্তার ঘটালো। মানুষ নিজের জন্য যে নতুন এক ধরনের পরিবেশ গড়ে তুললো তা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ নামে পরিচিত হলো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক মানুষ ক্রমে সামাজিক মানুষ ও অর্থনৈতিক মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
৪। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পায়নের কাল (Period of Science Technology & Industrialization )
বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রসারের ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ তার পরিবেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হলো। প্রযুক্তি সম্পন্ন মানুষ শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক হারে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করতে শুরু করল। প্রশাসনিক নগর, শিল্পনগর, বাণিজ্যিক নগর, বিশ্ববিদ্যালয় নগর প্রভৃতির বিস্তৃতির ফলে বিশ্বব্যাপী পরিবেশিক সংকট সৃষ্টি হল এবং পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্ককে অনেক জটিল করে তুলেছে। প্রযুক্তি সম্পন্ন মানুষের কার্যকলাপের ফলে জৈব মন্ডলীয় বাস্তুতন্ত্রের জৈব ও অজৈব উপাদান গুলোর যুগপৎ পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। ওপরের আলোচনাগুলোর ভিত্তিতে পরিবেশের উপর মানুষের হস্তক্ষেপের ধারাকে দুইটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-
(I) সরাসরি বা ইচ্ছাকৃত প্রভাব (Direct or intentional impacts)
ফসল উৎপাদনের জন্য বন জঙ্গল পরিষ্কার বা তৃণভূমি পুড়িয়ে ফেলা, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গাছ কাটা, নতুন কৃষি প্রযুক্তি, নতুন উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচ সুবিধা প্রভৃতির মাধ্যমে ফসলের ধরনের পরিবর্তন সাধন বাঁধ নির্মাণ, পানি সঞ্চয়ের আঁধার নির্মাণ, খাল খনন, নদী খাতের দিক পরিবর্তন, বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ, সড়ক পথ ও বড় বড় সেতু নির্মাণ, নগরায়নের পরিব্যাপ্তি, মাটি খুঁড়ে কয়লা, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, দস্তা প্রভৃতি পেট্রোলিয়াম উত্তোলন, সেচের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন সরাসরি ইচ্ছাকৃত প্রভাব সৃষ্টির অন্তর্গত।
(II) পরোক্ষ বা অনিচ্ছাকৃত প্রভাব (Indirect or unintentional impacts)
অর্থনীতির উন্নতির প্রয়োজনের পরিণতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা অবস্থায় মানুষ যেসব কাজ করে সেগুলো পরিবেশের উপর পরোক্ষ প্রভাব ফেলে। মানুষের উদ্দেশ্যমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে পরবর্তী পরিণতি বা প্রভাব সম্বন্ধে চিন্তা না করে স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক পন্থায় আবহাওয়া পরিশোধন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাধন প্রভৃতি পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। ফলে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় এরূপ সমস্যার মারাত্মক আকার ধারণ করে। পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া কোন কোন ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদী হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামগ্রিকভাবে মানব সমাজের জন্য দুঃখ দুর্দশার কারণ হয়ে পড়েছে।
উপসংহার
মানুষ ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া সম্পর্ক সর্বদা পরিবর্তনশীল। প্রাচীনকালে প্রাকৃতিক মানুষের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক ছিল বেশি নিবিড়, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক। নির্বিচারে প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ধ্বংস, মাটিকাটা প্রভৃতি অবিবেচনাপূর্ণ কার্যকলাপের ফলে পরিবেশের সাথে মানুষের আচরণের পরিবর্তন হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে প্রাকৃতিক মানুষই সামাজিক মানুষ, অর্থনৈতিক মানুষ ও পরে প্রযুক্তি সম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়ে পরিবেশের প্রতি বৈরিতা শুরু করে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় সামগ্রিকভাবে মানবজাতির জন্য যে অশুভ এবং প্রত্যক্ষ পরোক্ষ যে সব ক্ষতির কারণ হচ্ছে তা নিরসনের ব্যবস্থা করা যায়।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url