পৃথিবীর গতি কি এবং আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতির কারণ বা স্বপক্ষে যুক্তি
প্রিয় পাঠক, আপনি কি পৃথিবীর গতি এবং আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতির স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য সোর্স এর খোঁজ করছেন? তাহলে আপনার জন্য আমার এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আজকের এই প্রতিবেদনে পৃথিবীর গতি কি, আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি কাকে বলে এবং আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির স্বপক্ষে যুক্তি সমূহ ছাড়াও আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। আপনি প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকলে এ বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবেন।
ভূমিকাঃ
জ্ঞান বিকাশের সাথে সাথে মানুষ লক্ষ্য করে প্রতিদিনই সূর্য ভোরবেলায় পূর্ব আকাশে ওঠে এবং পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। প্রাচীনকালে মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী স্থির রয়েছে আর সূর্য মহাশূন্যের বুকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। আপাত দৃষ্টিতে তা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা ঠিক তার বিপরীত।
আসলেই সূর্য আছে এবং পৃথিবী নিজ দেহকে পাক খাওয়াতে খাওয়াতে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে চলেছে। ভারতের আর্যভট্টই সম্ভবত প্রথম মানুষ, যিনি বলেছিলেন পৃথিবী স্থির নয়,গতিশীল। পরবর্তীকালে গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, কেপলার ইত্যাদি জ্যোতিষবিজ্ঞানীরা এমত সমর্থন করেন।
পৃথিবীর গতি কি (The Movements of the Earth)
সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্রের মত পৃথিবী তার নিজের মেরু রেখা বা মেরুদন্ডের উপর নির্দিষ্ট কক্ষপথে নির্দিষ্ট গতিতে পশ্চিমদিক থেকে পূর্বদিকে প্রতিনিয়ত ঘুরে চলেছে। পৃথিবীর এই আবর্তন কে পৃথিবীর গতি বলে।
পৃথিবী তার নিজঅক্ষে স্থির থেকে পশ্চিমদিক থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে আবার একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে প্রতিনিয়ত ঘুরছে। সুতরাং এই কারণেই জ্যোতিষ বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর এই গতিকে দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১। আহ্নিক গতি (Diurnal Motion) এবং
২। বার্ষিক গতি (Annual Motion)।
আহ্নিক গতি (Diurnal Motion)
পৃথিবী তার নিজ অক্ষরেখার চারপাশে পশ্চিমদিক থেকে পূর্বে ২৩ ঘন্টা এবং ৫৬ মিনিট ও ৪ সেকেন্ড অর্থাৎ প্রায় ২৪ ঘন্টায় একবার আবর্তন করে। পৃথিবীর এই ধরনের গতিকে আহ্নিক গতি বলা হয়। আহ্ন শব্দের অর্থ দিন, এই শব্দ থেকেই আহ্নিক নামকরণ করা হয়েছে।
সূর্যকে সামনে রেখে পৃথিবী ১ বার সম্পূর্ণ রূপে আবর্তন করে বলে এই সময়কে সৌর দিন বলে। আহ্নিক গতির সময়কাল প্রতি ঘন্টায় ১৬১০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলটি কিছুটা স্ফীত এবং মরুপ্রদেশে কিছুটা চ্যাপ্টা।
ফলে পৃথিবীর মধ্যভাগে অর্থাৎ নিরক্ষীয় অঞ্চলে পৃথিবীর পরিধি বেশি বলে এ অংশে আবর্তনের পরিমাণ বেশি ঘন্টায় 1610 কিলোমিটার। এই গতিবেগ মেরু অঞ্চলের দিকে ক্রমশ কমতে থাকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বিন্দুতে আবর্তনের গতিবেগ একেবারেই থাকে না বললেই চলে।
আহ্নিক গতি প্রমাণের স্বপক্ষে প্রমাণ (Proofs of Rotation)
পৃথিবীর আহ্নিক গতি বা পৃথিবী নিজে যে আবর্তন করে তার স্বপক্ষে বৈজ্ঞানিকগণ যেসব প্রমাণ বা যুক্তি পেশ করেছেন তার কিছু তথ্য প্রমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১। সূর্য উদিত হওয়ার কারণে ঃ
সূর্য প্রতিদিন পূর্ব থেকে উঠে, এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। এই কারণে আমরা অনুমান করতে পারি যে, হয় সূর্য ঘুরছে না হয় পৃথিবী ঘুরছে। পৃথিবী এই গতিসম্পন্ন হচ্ছে একদিনে বা ২৪ ঘন্টায়। পৃথিবী থেকে সূর্য ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে মহাকাশে অবস্থান করছে। এত দূর থেকে সূর্যের পক্ষে .২৪ ঘন্টায় পৃথিবীকে প্রশিক্ষণ করা সম্ভব নয়।
২৪ ঘন্টায় পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে আসতে সূর্যের যে প্রচন্ড গতিবেগের প্রয়োজন তা আলোর গতির চেয়ে বেশি হতে হবে। যা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, কোন পদার্থই আলোর চেয়ে দ্রুতগামী হতে পারে না। তাই সূর্য নয়, পৃথিবীই ২৪ ঘন্টায় নিজ মেরুরেখার উপর একবার আবর্তন করছে।
২। পৃথিবীর আকৃতি ঃ
পৃথিবীর মধ্যভাগ কিছুটা স্ফীত এবং মেরু অঞ্চলে কিছুটা চাপা। কোন নমনীয় বস্তু তার অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে থাকলে এরকম হয়। পৃথিবীর এই আকৃতি আবর্তন গতির ফলে সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানী নিউটন বলেন যে, পৃথিবীর আবর্তনের ফলেই এর আকৃতি এমন হয়েছে।
৩। মহাকর্ষণ সূত্রের সাহায্যে ঃ
মহাকর্ষণের নিয়ম অনুযায়ী কোন বড় ও ভারী বাস্তু কখনোই তার চেয়ে ছোট ও হালকা বস্তুর দিকে ঘুরতে পারে না। পৃথিবীর চেয়ে সূর্য ১৩ লক্ষ গুণ বড়। কাজেই সূর্যের পক্ষে ওই নিয়ম অনুসারে পৃথিবীকে আবর্তন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা যে গতি লক্ষ্য করি তা সূর্যের নয়, পৃথিবীর আহ্নিক গতি।
৪। বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্র স্রোত ঃ
পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের পরিবর্তন ঘটেছে। আহ্নিক গতির ফলেই সমুদ্রস্রোত ও বায়ু প্রবাহ উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের গতিবেগ থেকে বোঝা যায় যে, পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে।
৫। উঁচু স্থান থেকে বস্তু নিক্ষেপ ঃ
উঁচু কোন জায়গা থেকে ভারী কিছু অথবা পাথর নিচের দিকে ফেলে দিলে তা সরাসরি লম্বভাবে নিচে মাটিতে না পড়ে সামান্য পূর্ব দিকে সরে মাটিতে পতিত হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করছে বা পৃথিবীর আবর্তন গতি রয়েছে।
৬। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি ঃ
আমরা প্রত্যেকে অবগত আছি যে, চন্দ্রের আকর্ষণের সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। চন্দ্র ২৭ দিনের পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর আবর্তন গতি না থাকলে ২৭ দিন পর একবার মুখ্য জোয়ার হতো। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিদিন নিজ অক্ষের উপর একবার আবর্তন করে বলে প্রতিদিন একবার সাগরে মুখ্য জোয়ার হয়।
৭। উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ ঃ
সম্প্রতি পৃথিবী থেকে যেসব উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, তাদের পাঠানো ছবি থেকে দেখা যায় যে, পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে।
৮। ফেরেলের সূত্র ঃ
১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফেরেল পরীক্ষা করে দেখেন যে, বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্র স্রোত উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধ বাম দিকে বেঁকে যায়। পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘূর্ণাবর্তনের ফলে কেন্দ্রাতিগ বলের কারণে এরূপ অবস্থা ঘটে।
বার্ষিক গতি (Annual Motion)
পৃথিবী আমাদের সৌরজগতের একটি গ্রহ হওয়ায় এটি অবিরতভাবে উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে পরিক্রমণ করছে। এই পরিক্রমণ পূর্ণ হতে পুরো এক বছর সময় অতিবাহিত হয়। এজন্য এই গতিকে বার্ষিক গতি বলে। একটি পূর্ণ বার্ষিক গতির ফলে একটি সৌর বছর অতিবাহিত হয়।
বার্ষিক গতির গড়বেগ ঘন্টায় ১০৬২৬০ কিলোমিটার। একটি পূর্ণ বার্ষিক গতি সম্পন্ন করতে পৃথিবীর মোট ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড সময় লাগে। বার্ষিক গতির ফলে ঋতু পরিবর্তন এবং দিবারাত্রি হাস বৃদ্ধি হয়।
পৃথিবীর বার্ষিক গতির স্বপক্ষে প্রমাণ (Proof of Earths Revolution)
পৃথিবীর আহ্নিক গতির মতো বার্ষিক গতির অবস্থা আমরা অনুভব করতে না পারলেও নিচের যুক্তিগুলো বলে দেয়, পৃথিবীর বার্ষিক গতি বা পরিক্রমণ গতি বিদ্যমান।
১। সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের গতি ঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা গেছে যে, সূর্যের অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে বছরে একবার পরিক্রমণ করছে, পৃথিবী ও সূর্যকে কেন্দ্র করে বছরে একবার পরিক্রমণ করছে আর এটাই স্বাভাবিক।
২। নক্ষত্রের অবস্থান ঃ
রাতের আকাশে নির্দিষ্ট কয়েকটি নক্ষত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কোন একটি তারা প্রতিদিন একই জায়গা থেকে উদিত হয় না। এটি আকাশের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে এবং কিছুদিন পর দেখা যাবে তারাটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ঠিক এক বছর পরে ওই তারাকে আগে আবার পূর্বের অবস্থানে দেখা যাবে। নক্ষত্র গুলো স্থির হওয়ায় পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে নক্ষত্র গুলোর এই রূপ অবস্থানের পরিবর্তন হয়।
৩। ঋতু পরিবর্তন ও দিবা-রাত্রির হ্রাস বৃদ্ধির সাহায্যে ঃ
পৃথিবীর যদি বার্ষিক গতি না থাকতো তবে পৃথিবীর উভয় মেরুতে সর্বক্ষণ হয় দিন না হয় রাত থাকতো। কিন্তু দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন এবং দিবারাত্রির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটেছে। সুতরাং পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে এরূপ লক্ষ্য করা যায়।
৪। মহাকর্ষ্য সূত্রের সাহায্যে ঃ
নিউটনের বিজ্ঞানীর মহাকর্ষ সূত্র মতে বড় বস্তু কখনই ছোট বস্তুর চারপাশে ঘুরতে পারে না। তাই পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুণ বড় সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর পক্ষে প্রদক্ষিণ করায় স্বাভাবিক। এর থেকে প্রমাণিত হয় পৃথিবীর বার্ষিক গতি রয়েছে।
৫। সূর্যের পরিবর্তিত অবস্থানের সাহায্যে ঃ
পৃথিবীর বার্ষিক গতি যদি না থাকতো, শুধুমাত্র আহ্নিক গতি থাকত, তাহলে প্রতিদিন সূর্যকে একই স্থান থেকে উদিত হতে দেখা যেত। কিন্তু আমরা আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পাই যে, সূর্য বছরের ছয় মাস ধীরে ধীরে উত্তরের দিকে সরে গিয়ে পূর্ব আকাশে ওঠে।
আবার বাকি ৬ মাস সূর্য ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে পূর্ব আকাশে ওঠে। শুধুমাত্র ২১ শে মার্চ ও ২৩ শে সেপ্টেম্বর আকাশে উঠে এবং পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। এর থেকে বোঝা যায় যে, পৃথিবীর বার্ষিক গতি রয়েছে।
উপসংহার
পৃথিবী থেকে পাঠানো বিভিন্ন মহাকাশযান ও কৃত্রিম উপগ্রহের শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও ক্যামেরার সাহায্যে দেখা গেছে যে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করে ও নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর পরিক্রমণ গতি আছে। এর সর্বাধুনিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে পৃথিবীর সত্যিকারে বার্ষিক গতি সত্যিকারেই রয়েছে।
মন্তব্য,
আমি আশা করছি, আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে পৃথিবীর গতি, আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি এবং আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির স্বপক্ষে প্রমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পরিপূর্ণভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। উক্ত শিরোনামে বিশ্লেষণধর্মী ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেখকের বই এবং রিপোর্ট এর সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে যদি আপনার কোন মন্তব্য থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। সর্বদাই নিজের খেয়াল রাখবেন, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url