মডেলের সংজ্ঞা এবং মডেলের শ্রেণীবিভাগ সমূহ আলোচনা
প্রিয় পাঠক, মডেল কি এবং মডেলের শ্রেণীবিভাগ সমূহ আলোচনা বিস্তারিত জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাটাঘাঁটি করছেন, এই বিষয়ে সঠিক এবং মনের মত তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না, তাহলে আপনার জন্য এর প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের এই প্রতিবেদনে মডেলের সংজ্ঞা এবং মডেলের শ্রেণী বিভাগ সমূহ, এ সমস্ত বিষয় সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। চলুন এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন।
ভূমিকা
যখন মনের কোনো কল্পনা বা ধারণাকে বাস্তব রূপে পরিণত করা চলেছে তখন তাকে মডেল বলে। মডেল সময়, অবস্থান ভেদে পৃথিবীর যেকোনো দেশে কার্যকারী ও ফলপ্রসু ভূমিকা রাখে। যেমন পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা সহ বিভিন্ন উপজাতি তথা আপামর জনতা সার্বজনীনভাবে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে তখন এই প্রথাকে মডেল বলে।
মডেল ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন প্রখ্যাত মনীষী ক্রিস্টোলারের কেন্দ্রীয় স্থান মডেল, কৃষিবিদ ভনথুনেন এর কৃষি ও তত্ত্ব মডেল, ম্যালথাসের জনসংখ্যা মডেল, জার্মান ভূগোলবির ওয়েবারের শিল্পতত্ত্ব মডেল, প্রখ্যাত মনীষী হ্যাগার স্ট্যান্ডের ব্যাপন মডেল প্রভৃতি ভূগোল বিষয়ের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল হিসেবে পরিচিত।
মডেলের সংজ্ঞা (Definition of Model)
মডেল বলতে বুঝি প্রকৃত বস্তুর প্রতিকৃতি। হাজার বছর ধরে ভূগোলে মডেল ব্যবহারের নমুনা লক্ষ্য করা যায়। যেমন মানচিত্র বা গ্লোব প্রতিকৃতি পৃথিবীর একটি প্রতীকৃতি। বিভিন্ন ভূগোলবিদ বিভিন্নভাবে মডেলের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এগুলো হলো-
১। ভূগোলবির চরলি ও হ্যাগেটের মতে, মডেল হল বাস্তবতার সাথে তত্বীয় পর্যায়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন যা যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে সহজীকরন, পরীক্ষা গ্রহণ,ক্রীড়াকার্য সম্পাদন করা, সম্প্রসারণ, বিশ্বায়ন তত্ত্ব গঠনে ও গবেষণার সাথে ব্যাখ্যার সাথে যোগসূত্র থাকে।
২। ১৯৬৪ সালে ভূগোলবিদ স্কিলিং এর মতে, মডেল হল একটি তত্ত্ব, অথবা একটি সূত্র, অথবা একটি মতবাদ, অথবা একটি সুসংগঠিত ধারণা।
৩। ১৯৬৫ সালে ভূগোলবিদ পিটার হাগেট এর মতে, মডেল হল বাস্তবতার একটি সহজবদ্ধ রূপান্তর যা তৈরি হয় বাস্তবতার কিছু প্রকৃত গুনাগুন প্রদর্শন করতে।
৪। ভূগোলবিদ এলেন রে মডেলের সংজ্ঞা এভাবে দেন তা হল, মডেল একটা সিস্টেম, বা বাস্তুবিকভাবে প্রয়োজনীয় কাঠামো উপহার দেয়।
৫। ১৯৫৭ সালে ভূগোলবিদ মিডজ মডেলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, মডেল হল বাস্তবের সাথে মিল রেখে একটি কাঠামো যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ অথবা সম্পর্কসমূহ মোটামুটি ভাবে প্রদর্শন করে।
উপরোক্ত সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, মডেল ভূগোলের এমন একটি হাতিয়ার, কলাকৌশল যা বাস্তবতা সম্পর্কে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেয়। অর্থাৎ বাস্তবতা বলতে আমরা বাস্তব অবস্থাকে সরল আকারে উপস্থাপন করাকেই মডেল বলি।
মডেলের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Model)
মডেল প্রধানত দুই প্রকার। যথা-
(ক) প্রাকৃতিক মডেল (Physical Model) এবং
(খ) ধারণাকৃত মডেল (Conceptual Model)।
(ক) প্রাকৃতিক মডেল (Physical Model) ঃ
পর্বত, মালভূমি, ভূমির ঢাল, প্রভৃতি প্রাকৃতিক অবয়বগুলো শ্রেণীকক্ষে হাতে ও কলমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে মডেল তৈরি করে প্রদর্শন করা হয় তাকে প্রাকৃতিক মডেল বলে।
মডেল বলতে নির্দিষ্টভাবে প্রকৃত বস্তুর রূপকে বোঝানো হয়েছে। মানচিত্র বা গ্লোব প্রকৃতপক্ষে সমগ্র পৃথিবীর মডেল। ভূগোলে বাস্তব জিনিস নিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। বাস্তব বিষয় যেমন- মালভূমি, পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, সাগর, নদী শ্রেণীকক্ষে উপস্থাপন করা সম্ভবপর নয়।
মালভূমি, পাহাড়, পর্বত, সমভূমি, জলাভূমি, সাগর, নদী, হ্রদ প্রভৃতি ভূমির বন্ধুরতা সম্পর্কে ভূগোল এর ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে পঠন পাঠনের জন্য মডেল তৈরি করে উপস্থাপন করা হয়। এ সকল মডেল তৈরির জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাদামাটি, পুটিং, কাগজের মন্ড, শোলা ইত্যাদি জোগাড় করে ব্যবহার করতে হয়।
(খ) ধারণাকৃত মডেল (Conceptual Model) ঃ
মডেল সাধারণত ধারণা বা কল্পনার বাস্তব রূপ। এজন্য যখন প্রতিমা মডেল গুলো বাস্তবতার ক্ষুদ্র রূপ হিসেবে দেখানো যায় তখন তাকে ধারণাকৃত মডেল বলে। যখন কোন মডেলের বাস্তবতার ক্ষুদ্র রূপ দেখানো হয় আর তখনই একটি মডেল অধিকতরভাবে একটি ধারণাগুলো মডেলে রুপ লাভ করে। ধারণাকৃত মডেলকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। পরীক্ষামূলক মডেল (Experimental Model),
২। প্রকৃতিগত মডেল (Natural Model) এবং
৩। গাণিতিক মডেল (Mathematical Model) ।
১। পরীক্ষামূলক মডেল (Experimental Model) ঃ
যে শ্রেণীর মডেল বস্তুর আদর্শ গুণাগুণ অনুসন্ধান করে বাস্তব কাঠামোতে রূপান্তরিত করা হয় ওই শ্রেণীর মডেলকে পরীক্ষামূলক বা গবেষণামূলক মডেল বলে। পরীক্ষামূলক বা গবেষণামূলক মডেল কে পুনরায় তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা-
(I) স্কেলগত মডেল (Scale Model) ,
(II) এনালগ মডেল (Analogue Model) এবং
(III) রৈখিক মডেল (Graphical Model) ।
(I) স্কেলগত মডেল (Scale Model) ঃ
স্কেলগত মডেল হল বাস্তবতার সাথে মিল রেখে অংশ বিশেষের বা কখনো কখনো পূর্ণাঙ্গ অনুকরণ মাত্র তৈরি মডেলকে স্কেলগত মডেল বলে। স্কেলগত মডেল প্রাকৃতিক ভূগোলে অত্যাধিক সাফল্যভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ভূগোলবিদ রোজ (Rouse), আবহাওয়া জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করতে স্কেল মডেল ব্যবহার করেন।
(II) এনালগ মডেল (Analogue Model) ঃ
যে মডেল দ্বারা স্কেলগত মডেলকে আরও সারসংক্ষেপ আকারে দেখানো যায়, ওই মডেলকে এনালগ মডেল বলে। যেমন সামোন্নতি রেখার সাহায্যে ভূমিরূপ দেখানো হয়। এনালগ মডেল দ্বারা খুব সহজেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়।
(III) রৈখিক মডেল (Graphical Model) ঃ
যেসব মডেলে বাস্তবতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা উপস্থাপন করে মডেলকে রৈখিক চিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় তাকে রৈখিক মডেল বলে। গ্লোব মানচিত্র এবং ডায়াগ্রাম যা প্রত্যেকটি এক একটি আদর্শ মডেল।
২। প্রকৃতিগত মডেল (Natural Model) ঃ
যেসব মডেলে প্রথম সহজীকরণ ও সরল ভাবে মডেল তৈরি করে সমীক্ষা ও পর্যালোচনা করে আরো মডেল দ্বারা পুনরায় আরও একবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা হয় তাকে প্রকৃতিগত মডেল বলে। প্রকৃতিগত মডেল আবার দুই প্রকার। যথা-
(I) ঐতিহাসিক প্রকৃতিগত মডেল (Historical Natural Model) এবং
(II) এনালগ প্রকৃতিগত মডেল (Analogue Natural Model) ।
(I) ঐতিহাসিক প্রকৃতিগত মডেল (Historical Natural Model) ঃ
সহজীকরণ মডেল বিভিন্ন সময় কিংবা স্থানের স্থিতিশীল না হয়ে কখনো গতিশীল রূপান্তরের ধারণা দেয় মাত্র। আবার কখনো কখনো ঘটনার ঐতিহাসিক বর্ণনা পুনরাবৃত্তির ধারণা দিয়ে থাকে। তখন ওই ধারণাকৃত মডেলকে ঐতিহাসিক প্রকৃতিগত মডেল বলে।
(II) এনালগ প্রকৃতিগত মডেল (Analogue Natural Model) ঃ
সহজীকরণ মডেলে যেসব প্রকৃতিগত ধারণা বা পদ্ধতির মাধ্যমগুলো প্রকৃতিগত পরিস্থিতি রূপান্তরিত করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে তাকে এনালগ প্রকৃতিগত মডেল বলে। সামাজিক ভূগোলের সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ এবং চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে প্রাকৃতিক এনালগ এর ভিত্তিতে প্রভাব বিস্তার করে।
৩। গাণিতিক মডেল (Mathematical Model) ঃ
যে মডেলের দ্বারা সমগ্র পৃথিবীর সম্পর্কিত তথ্য বা উপাত্ত গুলোকে যখন সংখ্যাসূচক সম্পর্ক সূত্র এবং সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে গাণিতিক মডেল বলে। গাণিতিক মডেল আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(I) নিয়ন্ত্রণবাদ মডেল (Determinestic Model) ,
(II) পরিসংখ্যানেক মডেল (Statistical Model) এবং
(III) সম্ভাবনাবাদ মডেল (Possibilistics Model)
(I) নিয়ন্ত্রণবাদ মডেল (Determinestic Model) ঃ
নিয়ন্ত্রণবাদ মডেল মূলতভাবে সাধারণত মডেল অন্তর্গত। এজন্য এ মডেলটি গাণিতিক ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সুতরাং এই মডেলের সঠিকভাবে ও নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয় বলে একে নিয়ন্ত্রণবাদ মডেল বলে। নিয়ন্ত্রণবাদ মডেল অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য মূলক।
(II) পরিসংখ্যানেক মডেল (Statistical Model) ঃ
এ মডেলগুলোর সম্ভাবনা মডেলগুলোর ধারনার উপর প্রভাব বিস্তার করে গড়ে ওঠে। এ মডেলগুলোতে প্রচুর উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় এবং সংগৃহীত উপাত্ত গুলো গবেষণা ও সমীক্ষা করার জন্য নানাবিধ কলাকৌশল ব্যবহার করা হয় বলে একে পরিসংখ্যানিক মডেল বলে।
(III) সম্ভাবনাবাদ মডেল (Possibilistics Model) ঃ
এই মডেলের ধারনার ফলাফল নির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না তবে মডেলের যে ফলাফল পাওয়া যায় সম্ভবত ধারণার ভিত্তিতে। এজন্য এ জাতীয় মডেলকে সম্ভাবনা বাদ মডেল বলে। সম্ভাবনা বাদ মডেল আবার তিন প্রকার। যথা-
সাংকেতিক মডেল (Symbolic Model) : যে মডেলে কতগুলো প্রতীক বা সংখ্যা ব্যবহার এর মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ের প্রবাহ দেখানো হয়ে থাকে তাকে সাংকেতিক মডেল বলে।
এনালগ মডেল (Analogue Model) : এনালগ মডেলের ভূ-বিজ্ঞানীগণ ভূ-সংস্থানিক মানচিত্রগুলোতে সমোন্নতি রেখার সাহায্যে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতার ধারণা দেয় বলে একে এনালগ মডেল বলে।
আইকনিক মডেল (Iconic Model) : যখন কোন ছোট জিনিসকে বড় এবং বড় জিনিসকে ছোট করে প্রদর্শন করার জন্য যে মডেল তৈরি করা হয় তখন ঐ মডেলকে আইকনিক মডেল বলে।
দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে মডেল দুই প্রকার। যথা-
১। আরোহী মডেল (Inductive Model) এবং
২। অবরোহী মডেল (Deductive Model) ।
১। আরোহী মডেল (Inductive Model) ঃ
চুম্বকের গা ঘেঁষে এক টুকরো লৌহ খন্ড রেখে দিলে দীর্ঘদিন ওই লৌহ খন্ড চুম্বকের সংস্পর্শে চুম্বকে পরিণত হতে বাধ্য। এই প্রক্রিয়াকে চৌম্বকীয় আবেশ বা আরোহী বলে। তেমনি ভাবে সমাজে একটি গালি শব্দ হাজার বছর ধরে প্রচলিত থাকলে এই গালি শব্দ ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একদিন মডেলে পরিণত হয়।
২। অবরোহী মডেল (Deductive Model) ঃ
অবরোহে মডেল বাছাইকৃত মডেল। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ হতে ভূগোলবিদগণ প্রকৃতিগত উপাত্ত সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। অতঃপর আহরহিত উপাত্ত থেকে অপ্রাসঙ্গিক উপাত্ত গুলো বাছাই করে বাদ দিয়ে অবরোহী মডেল তৈরি করে। যশোর জেলার ফুটবল দল গঠন করতে হলে সেরা ১১ জন ফুটবল খেলোয়াড় বাছাই করতে হয়। যশোর জেলার আটটি উপজেলা ফুটবল দল প্রত্যেক দল প্রত্যেক দলের সাথে খেলবে। যে দল কখনো পরাজিত হবে না এ দলই সেরা দল। এ পদ্ধতিতে অবরোহী মডেল বলে।
মন্তব্য,
এতক্ষণ ধরে মডেলের সংজ্ঞা এবং মডেলের শ্রেণীবিভাগ সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এ বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ এবং সঠিক তথ্য ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছেন। এ বিষয় সম্পর্কে আপনার যদি কোন মন্তব্য থাকে তাহলে কমান্ড বাক্সে লিখে রাখবেন। আপনাকে ধন্যবাদ।।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url