বায়ুবাহিত রোগ কোনগুলো এবং বায়ুবাহিত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা
প্রিয় পাঠক, আপনি কি বায়ুবাহিত রোগ কোনগুলো এবং বায়ুবাহিত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য আগ্রহী, এ বিষয়ে তথ্য জানার জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করে সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অতি প্রয়োজনীয়।
আজকের এই প্রতিবেদনে বায়ুবাহিত রোগ কোনগুলো, এবং বায়ুবাহিত রোগ যেমন জলবসন্ত, সর্দি জ্বর, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষা রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। চলুন এগুলো বিস্তারিত দেখে নিই-
ভূমিকা
দেহকে সুস্থ রাখতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে যে সমস্ত নির্দেশিকা রয়েছে সেগুলো মেনে চলা উচিত। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমরা রোগে আক্রান্ত হই। আমাদের চারপাশে অসংখ্য রোগ জীবাণু রয়েছে, এই জীবাণু গুলো এত ছোট যে খালি চোখে তাদেরকে দেখা যায় না।
এদেরকে দেখতে হলে মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। এ সমস্ত রোগ জীবাণু বিভিন্নভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। প্রধানত পানির মাধ্যমে, বায়ুর মাধ্যমে এবং কীট পতঙ্গের দংশনের মাধ্যমে এসব জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি হয়।
বায়ুবাহিত রোগ
কিছু কিছু রোগ জীবাণু বায়ুর মাধ্যমে প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে। এগুলোকে বায়ুবাহিত রোগ বলে। যেমন সর্দি-কাশি, যক্ষা, জলবসন্ত, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে রোগীর থুথু, কফ ও হাচি থেকে জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
শ্বাস গ্রহণের সময় বাতাসের সাথে সেসব রোগ জীবাণু মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এরপর দেহের ভেতরে সেসব জীবাণুর বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটায়। চলুন এবার বায়ুবাহিত রোগগুলো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিন।
বায়ুবাহিত রোগ জলবসন্ত
জলবসন্ত একটি বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ। এক ধরনের ভাইরাস এই রোগ সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্ন উল্লেখ করা হলো-
জলবসন্তের লক্ষণঃ
কারো শরীরে জল বসন্ত হলে যে সমস্ত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো হল-
- গায়ে অল্প অল্প জ্বর ও প্রচন্ড ব্যথা হয়,
- দুই-তিন দিন পর প্রথমে বুকে ও পিঠে গুটি বা ফুসকুড়ি দেখা যায়,
- এরপর কয়েক দিনের মধ্যে সারা শরীরে গুটি বের হয়। গুটি গুলো নরম ও এগুলোর ভেতর পানির মত স্বচ্ছ তরল পদার্থ থাকে, ধীরে ধীরে এই স্বচ্ছ তরলটি ঘোলাটে ও গাঢ় হতে থাকে।
- কয়েকদিন পর গুটি বা ফুসকুড়ি গুলো শুকাতে আরম্ভ করে। এর সময় এগুলো খুব চুলকায়।
জলবসন্তের প্রতিকার ও প্রতিরোধঃ
জল বসন্ত হলে যে সমস্ত প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সেগুলো হল-
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসা করাতে হবে,
- নিম পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে রোগীর সারা শরীর মুছে দিলে রোগী আরাম বোধ করে।
- রোগীকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে।
- রোগী আলাদা থালা-বাসন, গ্লাস, বিছানা পত্র, কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
বায়ুবাহিত রোগ সর্দি জ্বর
সর্দি জ্বর একটি বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ। এক ধরনের ভাইরাসের জন্য এই রোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষত শীতের সময় এই রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি হয়। বড়দের তুলনায় শিশুদের তুলনামূলক বেশি হয়।
সর্দি জ্বরের লক্ষণঃ
এ রোগ হলে সাধারণত যে ধরনের লক্ষণ বহিঃপ্রকাশ হয়, সেগুলো হলো-
- শরীরের শীত শীত ভাব অনুভূত হয়
- ঘন ঘন হাচি ও কাশি হয়,
- শরীরে হালকা জ্বর থাকে, মাথা ব্যথা হয়,
- নাক দিয়ে সর্দি বের হয়,
- গলা ব্যথা হয়, ফলে খাদ্য গ্রহণ করতে বেশ অসুবিধা হয়।
- খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে রুচি কমে যায়, খুদা কমে যায়
- পেশিতে ব্যথা করে, ইত্যাদি।
সর্দি জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
সর্দি জ্বর হলে প্রত্যেকেই আমরা কমবেশি প্রাথমিক চিকিৎসা করে থাকি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ করুন,
- ঠান্ডা লাগলে শরীরকে উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা করুন,
- গলা ব্যাথা হলে কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া কুলি করুন,
- কাশি কমানোর জন্য কুসুম গরম পানিতে মধুর শরবত খান,
- লেবু চা খেতে পারেন,
- ভিটামিন সি এবং ভিটামিন সি জাতীয় ফল সর্দি জ্বর উপসমের জন্য উপকারী,
বায়ুবাহিত রোগ হাম
হাম হচ্ছে বায়ুবাহিত একটি অতি সংক্রামণ রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তি সংস্পর্শে আসলে ৯০% লোক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস-প্রশ্বাস, হাচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসে অনু পরিমাণ কনা (মাইক্রো-ড্রপলেট) সংক্রামিত হয়ে জীবাণু ছড়াতে পারে, উক্ত জীবাণু বাতাসে প্রায় দুই ঘন্টা সক্রিয় থাকতে পারে।
হাম এর লক্ষণ বা উপসর্গঃ
বায়ুবাহিত রোগ হাম হলে যে সমস্ত উপসর্গগুলো বা লক্ষণগুলো দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- হাম এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষণ হলো জ্বর,
- মুখের ভিতরে কপ্লিক স্পট দেখা যায়,
- সমস্ত শরীরে হাম এর গুটি দেখা যায়, এ ছাড়াও
- আলোতে সংবেদনশীলতা এবং পেশিতে ব্যথা দেখা যেতে পারে।
হাম এর প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
শরীরে হাম রোগে আক্রান্ত হলে যে সমস্ত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- জ্বর নিয়ন্ত্রণ করা, যেমন প্যারাসিটামল জাতীয় জ্বরের ঔষধ খাওয়া,
- শরীরের জলের পরিমাণ বৃদ্ধি করা,
- পর্যাপ্ত পরিমাণে চোখের যত্ন গ্রহণ করা, যেমন চোখ পরিষ্কার রাখা, বেশি আলোতে চোখ ব্যথা করলে আলোর তীব্রতা কমিয়ে রাখা,
- কাশি এবং ঠান্ডা লাগার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা,
- এছাড়াও অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট, রক্তবমি, শরীর ঝিমঝিম করা, কিং কর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা ইত্যাদি উপসর্গ আভাস পেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
বায়ুবাহিত রোগ ইনফ্লুয়েঞ্জা
ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি অতি সংক্রামণ রোগ যা হাচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, এই রোগ বছরের যেকোনো সময়েই যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে তবে, শীতকালে এর প্রভাব বেশি বিস্তার করে। এটি একটি বায়ুবাহিত রোগ। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত আছে এমন রোগীর সংস্পর্শে আসলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়াইতে পারে। পরিবারের একজনের ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হলে অন্যদের মধ্যেও এটি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের লক্ষণঃ
সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ঠান্ডা লাগার মতোই লক্ষণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যেমন জ্বর জ্বর ভাব, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে সর্দি পড়া, কাশি হওয়া ইত্যাদি। ঠান্ডা লাগার সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি সংক্রামক রোগ যা দ্রুত ছড়ায়। এ রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ গুলো হল-
- হঠাৎ করে জ্বরের তীব্রতা বৃদ্ধি,
- গলা ব্যাথা হয়, যার জন্য খাবার গ্রহণে অসুবিধা সৃষ্টি হয়,
- সর্দি-কাশি হতে থাকে,
- মাথাব্যথা সৃষ্টি হয়,
- ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,
- শরীর তুলনামূলক দুর্বল অনুভূত হয়,
- সর্দির কারণে নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে,
- বমি বমি ভাব কিংবা বমিও হতে পারে, ইত্যাদি।
ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে যে চিকিৎসা গ্রহণ করা যায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে,
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে অথবা ফলের রস পান করতে হবে যাতে শরীরে পানির ঘাটতি দেখা না যায়,
- শরীরে বা নিজেকে ঠান্ডা লাগানো যাবে না,
- যেহেতু ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি সংক্রামক রোগ সেহেতু তার ব্যবহৃত গ্লাস, প্লেট কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র যেন অন্য কেউ ব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা গ্রহণ করা যেতে পারে।
বায়ুবাহিত রোগ যক্ষা
যক্ষা একটি বায়ুবাহিত রোগ, টিউবারকুলোসিস এই রোগের জন্য দায়ী। চিকিৎসা না করলে একজন যক্ষা রোগী বছরে দশ জন সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে।
যক্ষা রোগের লক্ষণঃ
দুই সপ্তাহের অধিক সময় ব্যাপী কাশি ফুসফুসের যক্ষা রোগের অন্যতম কারণ, কাশির সাথে অন্যান্য যে লক্ষণ থাকতে পারে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- বিকেলের দিকে অল্প অল্প জ্বর,
- রাতে শরীর ঘেমে যাওয়া,
- খাবারে অরুচি, খাওয়ার খেতে ইচ্ছা হয় না।
- শরীরের ওজন কমে যাওয়া ও দিন দিন দুর্বল হয়ে যাওয়া,
- সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকে জ্বর না সারা,
- রোগ গভীর হয়ে গেলে কাশির সাথে রক্ত যেতে পারে, ইত্যাদি।
যক্ষা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
যক্ষা রোগের তেমন কোনো প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করার সুযোগ নেই, তবে যক্ষা রোগের লক্ষণ গুলো বহিঃপ্রকাশ ঘটলে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কফ পরীক্ষা করে যক্ষা রোগের জীবাণুর উপস্থিতি আছে কিনা তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
যক্ষা রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জন্মের পর শিশুকে বিসিজি টিকা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
যক্ষা হলে রক্ষা নেই, এই কথার ভিত্তি নাই, যক্ষা শনাক্তকৃত রোগীকে এ স্লোগানটি ভালোভাবে অবগত করতে হবে।
মন্তব্য
পরিশেষে বলা যায় যে, বায়ুবাহিত রোগ একটি ছোঁয়াচে রোগ, বায়ুবাহিত রোগ সাধারণত হাচি, কাশি, কফ, থুথু ইত্যাদির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে অন্যদের দেহে এই জীবানু প্রবেশ করে। এ ধরনের রোগ হলে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। আমি আশা করছি বায়ুবাহিত রোগ সম্পর্কে আমার এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url