ভূপৃষ্ঠে কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় অথবা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি
প্রিয় পাঠক, আপনি কি ভূগোল বিষয়ের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ কি, ভূপৃষ্ঠে কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় অথবা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাচ্ছেন, এই বিষয়ে জানার জন্য বিভিন্ন ধরনের বই পুস্তক ঘাটাঘাটি করছেন? তাহলে আপনার জন্য এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বলতে কি বুঝায়, নিরক্ষরেখা ও মূল মধ্যরেখা কি, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। চলুন এবার আমরা বিস্তারিত জেনে নিই-
ভূমিকাঃ
ভূপৃষ্ঠের কোন একটি স্থানের সঠিক অবস্থান জ্যামিতিক পদ্ধতিতে সহজে নির্ণয় করা যায়। দুইটি সরলরেখা যদি পরস্পরকে সমকোণে ছেদ করে তাহলে ওই রেখাদ্বয় থেকে কোন স্থানের দূরত্ব মেপে সেই স্থানের সঠিক অবস্থান বের করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতি স্বল্প পরিসর এলাকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। বিশাল পৃথিবীর অসংখ্য স্থানের অবস্থান নির্ণয় এভাবে করা সম্ভব নয়।
যেহেতু পৃথিবী গোলাকার তাই কোন স্থানের অবস্থান বের করতে হলে তা কোণের সাহায্যে মাপতে হয়। অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল কোন একটি স্থানের কৌণিক দূরত্ব। আর কোন স্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করতে গেলে নিরক্ষরেখা ও মূল মধ্যরেখার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
নিরক্ষরেখা (Equator)
উত্তর ও দক্ষিণ মেরু হতে সমান দূরত্বে পৃথিবীর ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে পূর্ব- পশ্চিমে বেষ্টনকারী যে বৃহৎ বৃত্ত সমগ্র পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণে সমান দুই ভাগে ভাগ করেছে তাকে নিরক্ষরেখা (Equator) বলা হয়। নিরক্ষীয় বৃত্ত পৃথিবীর বৃহৎ বৃত্ত (Great circle)। রেখার মান শূন্য ডিগ্রি।
মূল মধ্যরেখা (Prime Meridian)
পৃথিবীর ঠিক মধ্য বরাবর উত্তর দক্ষিনে লন্ডনের গ্রিনিচ শহরের রাজকীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গ্রীনিস মানমন্দির এর ওপর দিয়ে যে দ্রাঘিমা রেখা কল্পিত হয়েছে সেটিকে মূল মধ্যরেখা (Prime Meridian) বলে। মূল মধ্যরেখার দ্রাঘিমাংশ শূন্য ডিগ্রি ধরা হয়।
অক্ষাংশ ও অক্ষরেখা (Latitude and Parallels of latitude) :
পৃথিবীর ওপর অবস্থিত কোন স্থানে নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর বা দক্ষিণের যে কৌণিক দূরত্ব, তাকে সেই স্থানের অক্ষাংশ বলা হয়। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের কোন স্থান থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত যদি কোন সরলরেখা টানা যায় তাহলে ওই রেখা নিরক্ষীয় তলের সাথে যে কোন তৈরি করবে সেই কোণই হবে ওই স্থানের অক্ষাংশ (Latitude)।
নিরক্ষরেখা থেকে অক্ষাংশ গণনা শুরু হয়। সুতরাং নিরক্ষরেখার অক্ষাংশ হলো ০ ডিগ্রি। নিরক্ষরেখার উত্তরে অবস্থিত অক্ষাংশকে উত্তর অক্ষাংশ, এবং দক্ষিণে অবস্থিত অক্ষাংশকে দক্ষিণ অক্ষাংশ বলা হয়। নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী অঞ্চলের অক্ষাংশ (০ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি) নিম্ন অক্ষাংশ, (৩০ ডিগ্রি থেকে ৬০ ডিগ্রি) মধ্য অক্ষাংশ, এবং (৬০ ডিগ্রি থেকে ৯০ ডিগ্রি) পর্যন্ত উচ্চ অক্ষাংশ নামে পরিচিত।
অক্ষাংশের উপর অবস্থিত স্থানগুলোকে কোন কাল্পনিক রেখা দ্বারা যোগ করলে যে রেখার সৃষ্টি হয় তাকে অক্ষরেখা বলে। নিরক্ষরেখা হলো প্রধান অক্ষরেখা। নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরে বা দক্ষিনে ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত যে কোন বিন্দুর মধ্য দিয়ে নিরক্ষরেখার সমান্তরালে যে রেখায় কল্পনা করা যাক না কেন, তাই হবে এক একটি অক্ষরেখা। অক্ষরেখা গুলো পরস্পর সমান্তরাল বলে এদেরকে সমাক্ষরেখাও (Parallels of latitude) বলা হয়।
অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি (Determination of Latitude)
(ক) উত্তর গোলার্ধের কোন স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতিঃ
১। ধ্রুবতারার সাহায্যে অক্ষাংশ নির্ণয়ঃ
উত্তর গোলার্ধের যেকোন স্থান থেকে উত্তর আকাশ মন্ডলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ধ্রুবতারাকে দেখা যায়। ধ্রুব নক্ষত্র বা ধ্রুবতারা চির স্থির। কিন্তু উত্তর গোলার্ধের সব জায়গা থেকে ধ্রুবতারাকে মহাকাশে দিগন্ত থেকে সমান উচ্চতায় দেখা যায় না।
পৃথিবীর মানচিত্রে স্থানভেদে এই উচ্চতার জন্য পার্থক্যের বিভিন্নতা ঘটে অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানের জন্য এই উচ্চতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। নিরক্ষরেখা থেকে ধ্রুবতারাকে ঠিক দিগন্ত রেখায় দেখা যায়। নিরক্ষরেখায় ধ্রুবতারার উন্নতি শূন্য ডিগ্রী।
নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর মেরুর দিকে প্রতি এক ডিগ্রী অবসর হতে থাকলে ধ্রুবতারার উন্নতি এক ডিগ্রি করে বাড়তে থাকবে। উত্তর মেরুতে ধ্রুবতারার কে ঠিক শিরোবিন্দুতে অর্থাৎ মাথার উপরে দেখা যায় অর্থাৎ উত্তর মেরুতে ধ্রুবতারার উন্নতি ৯০ ডিগ্রী হয়।
২। সূর্যের উন্নতি সাহায্যেঃ
সূর্য যেদিন যে অক্ষাংশের উপর লম্বভাবে কিরণ দেয় সেটাই সেদিনের সূর্যের বিষুব লম্ব। সূর্যের বিষুব লম্ব ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশের সীমাবদ্ধ। যে কোন একদিনের দক্ষিণ গোলার্ধে মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতি ৫০° এবং বিষুব লম্ব ১৫° দক্ষিণ হলে সে স্থানের অক্ষাংশ হবে-(৯০ ডিগ্রি দুপুরবেলা সূর্যের উন্নতি - বিষুব লম্ব ) (৯০°- ৫০° - ১৫°) ২৫°।
অর্থাৎ আলোচিত স্থানটি যদি উত্তর গোলার্ধে হয় তবে উত্তরবাচক বিষুব লম্ব যোগ এবং দক্ষিণবাচক বিষুব লম্ব বিয়োগ হবে। দক্ষিণ গোলার্ধ দক্ষিণবাচক বিষুব লম্ব যোগ এবং উত্তরবাচক বিষুব লম্ব বিয়োগ করে দেখতে হবে।
৩। খুঁটির সাহায্যেঃ
উত্তর গোলার্ধে কোন একটি খোলা জায়গায় সমতল জমির উপর একটি খুঁটি ঠিক লম্বভাবে পুঁতে দিতে হবে। তারপর আরো একটি সামান্য ছোট্ট খুঁটি আগের খুঁটি একটু দক্ষিনে এমন ভাবে পুঁতে দিতে হবে যেন, খুঁটি দুইটির দক্ষিণে দাড়িয়ে লক্ষ্য করলে তাদের মাথার সাথে ধ্রুবতারাকে একই কল্পিত সরল রেখায় দেখা যায়।
একবার খুঁটি দুইটির মধ্যভাগের ব্যবধান এবং তাদের দৈর্ঘ্য মেপে নিতে হবে। তারপর ছোট স্কেল অনুযায়ী কাগজের উপরে এই চিত্রটি উপস্থাপিত করে চাঁদার সাহায্যে কোন মেপে দেখলে যত ডিগ্রি কোণ পাওয়া যাবে তত ডিগ্রিই হবে ওই স্থানের অক্ষাংশ।
৪।সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে অক্ষাংশ নির্ণয়ঃ
যে যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি পরিমাপ করা যায় তাকে সেক্সট্যান্ট যন্ত্র বলে। এই যন্ত্রটির মধ্যে একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে এই যন্ত্রটি উত্তরমুখী করে আনুভূমিক রেখে এর ডিগ্রি ঠিক করতে হয়। পরে যন্ত্রটি ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে তুলতে হয়। এ সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে মধ্যাহ্নের সূর্যের উন্নতির কোন নির্ণয় করে নির্ভুলভাবে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়।
(খ) দক্ষিণ গোলার্ধের অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতিঃ
১। হ্যাডলির অকট্যান্ট নামক নক্ষত্রের উন্নতি দেখেঃ
উত্তর গোলার্ধের মত দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশে ধ্রুবতারা দেখা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ মেরুর কাছে ধ্রুবতারার মত হ্যাডলির অকট্যান্ট নামক অপর একটি স্থির নক্ষত্রের বা তারা সাহায্যে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো স্থানের অক্ষাংশ সে স্থানের হ্যাডলির অকট্যান্ট এর উন্নতির সমান হিসেবে নির্ধারিত হয়।
দ্রাঘিমাংশ ও দ্রাঘিমা রেখা (Longitude)
পৃথিবীর কেন্দ্র হতে মূল মধ্যরেখার পূর্ব বা পশ্চিমে কোন স্থানের কৌণিক দূরত্বকে ওই স্থানের দ্রাঘিমাংশ (Longitude) বলে। সহজ কথায় বলা যায়, পৃথিবীর কোন স্থানের অবস্থান মূল মধ্যরেখা ও কেন্দ্রের সাথে যে কোন উৎপন্ন করে তাকেই ওই স্থানের দ্রাঘিমাংশ (Longitude) বলে।
দ্রাঘিমাংশ বরাবর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে নিরক্ষরেখাকে লম্বভাবে ছেদকারী অর্ধবৃত্তগুলোকে দ্রাঘিমারেখা বা দেশান্তর রেখা বলে। এদের সাহায্যের মূলমধ্যরেখা থেকে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের বা দেশের পূর্ব-পশ্চিম দিকে অবস্থান নির্ণয় করা যায় তাই এদেরকে দেশান্তর রেখাও বলে।
মূল মধ্যরেখার পূর্বে অবস্থিত দ্রাঘিমা, পূর্ব দ্রাঘিমা এবং পশ্চিমে অবস্থিত দ্রাঘিমা, পশ্চিম দ্রাঘিমা নামে পরিচিত। মূল মধ্যরেখার পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিকে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত দ্রাঘিমা আছে। অর্থাৎ মূল মধ্যরেখার পূর্বদিকে ১৮০ টি এবং পশ্চিম দিকে ১৮০ টি দ্রাঘিমা রেখা অবস্থান করছে।
দ্রাঘিমা নির্ণয় পদ্ধতি (Determination of Longitude)
যেহেতু পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে কোন স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় সম্ভব নয় তাই মধ্যাহ্ন সূর্যের সর্বোচ্চ অবস্থান দেখে প্রথমে কোন স্থানের সময় নির্ণয় করা হয় তারপর পার্শ্ববর্তী স্থানের সাথে সময়ের পার্থক্য অনুসারে সে স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় করা হয়। এছাড়া গ্রিনিচের সময় দ্বারা ও কোন স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় করা যায়।
১। সময়ের পার্থক্য অনুসারে (According to the Difference of Time) :
আমাদের এই বসবাসের পৃথিবী গোলাকার এবং পৃথিবীর নিজ অক্ষ বা মেরুরেখার চারিদিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অনবরত আবর্তন করছে। ফলে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থান ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, সূর্যের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। যে সময়ের কোন স্থানের মধ্যে রেখা সূর্যের ঠিক সামনে আসে অর্থাৎ ওই স্থানে সূর্যকে
ঠিক মাথার ওপর দেখা যায়, তখন ওই স্থানের মধ্যাহ্ন হয় এবং ঘড়িতে বেলা ১২ টা বাজে। মধ্যাহ্ন অনুসারে দিনের অন্যান্য সময় নির্ণয় করা হয়। ১° দ্রাঘিমার পার্থক্যের জন্য সময়ের পরিবর্তন হয় ৪ মিনিট। তাই কোন স্থানের সময় যখন বেলা ১২ টা তখন সে স্থানের চেয়ে ১° পূর্বে অবস্থিত স্থানের দূরত্ব
হবে ১২ টা ৪ মিনিট (৪ মিনিট বেশি) এবং সেই স্থানের চেয়ে ১° পশ্চিমে অবস্থিত স্থানের সময় হবে ১১:৫৬ মিনিট (৪ মিনিট কম)। এভাবে সময়ের পার্থক্য অনুসারে কোন স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় করা হয়।
২। গ্রিনিস সময়ের মাধ্যমে (By the Help of Greenwich Time):
গ্রিনিচের দ্রাঘিমা ও ডিগ্রী এবং ক্রোনোমিটার নামক ঘড়ি গ্রিনিসের সময় অনুসারে চলে। সুতরাং গ্রিনিসের সময় এবং অন্য কোন স্থানের সময় জানতে পারলে সেই স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় করা যায়। পূর্বের দেশগুলোতে সময় এগিয়ে এবং পশ্চিমের দেশগুলো সময় পিছিয়ে থাকে। বলে গ্রিনিচের সময়ের চেয়ে কোন স্থানের স্থানীয় সময় বেশি হলে স্থানটি গ্রিনিচের পূর্বে এবং কম হলে স্থানটি গ্রিনিচের পশ্চিমে অবস্থিত বোঝা যায়।
মন্তব্য,
পরিশেষে বলা যায় যে, আজকের এই প্রতিবেদনে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, নিরক্ষরেখা, মূল মধ্যরেখা, ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় অথবা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয় সংক্রান্ত যদি আপনার কোন পরামর্শ থাকে তবে কমান্ড বক্সে জানিয়ে রাখবেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url