পিত্তথলির পাথর অপসারণের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি সমূহ
পিত্তথলিতে পাথর?এ বিষয় নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন? পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ গুলো কি, পিত্তথলির পাথর অপসারণের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি গুলো জানার চেষ্টা করছেন?এ বিষয়ে কি গুগলে অনেক সার্চ করেও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না ? চিন্তার কারণ নেই, আমি এ সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
আমার এই প্রতিবেদনের মধ্যে পিত্তথলিতে পাথর হলে কি হয়, পিত্তথলিতে পাথর কেন হয়, পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ,এর লক্ষণ গুলো কি কি? কি কিভাবে চিকিৎসা করা যায়,এছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, চলুন আমরা জেনে নেই এই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যগুলি
ভূমিকা
মানুষের শরীরে অভ্যন্তরে পিত্তকোষ বা পিত্তবাহী একটি নালী রয়েছে। এই পিত্তনালীতে পিত্তরস জমাট বেঁধে প্রস্তুরকণা আকার ধারণ করে, ইহাকে পিত্তপাথরী বলে। এই পিত্তপাথর যতদিন পিত্তকোষের মধ্যে থাকে ততদিন তেমন কোনো অসুবিধা লক্ষ্য করা যায় না।
কিন্তু যখন পাথরগুলো পিত্তনালীর মধ্যে নেমে আসে তখনই সমস্যা দেখা দেয়, এবং অসহ্য ব্যথা সৃষ্টি হয়। এই ব্যাথা প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি ছটফট করতে থাকে। প্রচন্ড ব্যথা ডান পাশ থেকে শুরু করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এবার আমরা জেনে নিব,পিত্তথলির পাথর অপসারণের ঘরোয়া পদ্ধতি গুলো.
পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ
পিত্তথলির পাথর সরানোর প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি আলোচনা করার পূর্বেই পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ গুলো বিশ্লেষণ করা উচিত।হেমলাইসিস জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত বিলোরুবিন সৃষ্টির জন্য পিত্ত থলিতে পাথর হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে শরীরের অভ্যন্তরে পিত্ত প্রবাহ ঠিকমত
কাজ না করলে বা অপসারণ না হলে পিত্ত প্রবাহ গুলি জমাট বেঁধে পাথর সৃষ্টি হয়। তুলনামূলক শারীরিক পরিশ্রম কম করা, এবং মানসিক পরিশ্রম তুলনামূলক বেশি হওয়া,মাছ এবং মাংস এবং বিভিন্ন ধরনের উত্তেজক পূর্ণ খাদ্য গ্রহণ করা, খাওয়া চুন খাওয়া, এবং শরীরের বিভিন্ন যান্ত্রিক কারণে বা গোলযোগের কারণে পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টি হতে পারে।
পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ
এবার আমরা জেনে নেই পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার লক্ষণগুলো।পিত্ত থলিতে পাথর হলে বেশ কিছু লক্ষণ উল্লেখ পায়। চলুন আমরা জেনে নিই,পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ গুলো , অর্থাৎ কি কি উপসর্গ হলে আমরা ধারণা করব যে পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে
- শরীরের কুক্ষিদেশ হতে শরীরের পেটের বিভিন্ন অংশে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষত ডান কাঁধ থেকে পিঠের চারিদিকে। এ ব্যথা আধা ঘন্টা ,এক ঘন্টা বা তারও বেশি স্থায়ী থাকতে পারে।
- পিত্তথলিতে পাথর হলে পেট ব্যথার সাথে বমি, এবং পিত্তবমি হতে পারে।
- প্রচন্ড পেট ব্যথার সাথে সাথে শরীরে ঠান্ডা ঘাম দেখা দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হয়।
- পিত্তথলিতে পাথর হলে অনেক সময় জন্ডিসের প্রভাব দেখা দেয়। এবং শরীর হলুদ বর্ণ হয়ে যেতে পারে।
- পিত্তথলিতে পাথর হলে উল্লেখযোগ্য লক্ষণ বোঝা যায় যে, পেটের ডান দিকে ব্যথার উৎপত্তি হয়ে ডান কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছাবে।
পিত্তথলির পাথর চিকিৎসা পদ্ধতি
পিত্তথলির পাথর সরানোর বা দূর করার প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি জানার আগে আমরা চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো জেনে নিই।পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ এ যদি তীব্র ব্যথা হয়,তাহলে চিকিৎসায় তেমন ভালো ফল পাওয়া যায় না।যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করে পাথর বের করাই উত্তম। পিত্তথলির পাথর চিকিৎসার জন্য সাধারণত দুইটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। যথাঃ
১। পিত্তথলি অপারেশন পদ্ধতি
সার্জারি করার মাধ্যমেঃ এ ক্ষেত্রে সরাসরি পেট কেটে পিত্তথলি থেকে পাথর অপসারণ করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনের পিত্তথলিও কেটে ফেলা হয়।ল্যাপরোস্কোপের সাহায্যেঃ এক্ষেত্রে রোগীর পেট কাটা হয় না। কিন্তু পেটে চারটি ছিদ্র করতে হয়, ছিদ্র করার মাধ্যমে ল্যাপারস্কপি যন্ত্রের সাহায্যে পেটের পাথর অপসারণ করা হয়ে থাকে।
তবে সার্জারি করার চেয়ে ল্যাপোরোস্কপি আধুনিক এবং জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
২। প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতিঃ
অপারেশন পদ্ধতি ছাড়াও হোমিও চিকিৎসা, পিত্তথলির পাথর প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া ভাবে চিকিৎসা করেও পিত্তপাথর অপসারণ করা যায়। তবে যখন পিত্ত কোষ থেকে পাথর পিত্তথলিতে নেমে আসবে, তখন আর ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যায় না। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, পিত্ত পাথর শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই চিকিৎসা বেশ কার্যকরী।
পিত্তথলির পাথর অপসারণের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি
পিত্তথলির পাথর শনাক্ত হওয়ার পরপরই দ্রুত চিকিৎসা করা প্রয়োজন। তবে পাথরের সাইজ ১০ মিলিমিটারের কম হলে তা বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে এই পাথর বের করা সম্ভব হতে পারে। আসুন আমরা জেনে নিই, পিত্তথলির পাথর অপসারণের ঘরোয়া পদ্ধতি
পিত্তথলির পাথর অপসরণে আপেল সিডার ভিনেগারঃ
আপেল এর রস আধাক্লাস,এর সাথে ভিনেগার এক টেবিল চামচ, একত্রে মিশ্রণ করে শরবত বানিয়ে পান করলে,পিত্তথলিতে পাথর জনিত ব্যথা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাবে। সকালে খালি পেটে এরকম মিশ্রণ বানিয়ে হালকা গরম করে
কয়েক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ভাবে পান করলে পিত্তথলির পাথর দ্রুত দ্রবীভূত হবে এবং এর ব্যাথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আপেল এর রস এবং ভিনেগারের এসিড পিত্তথলির পাথর দ্রবীভূত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে লেবুর রসঃ
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে তিনটি তাজা লেবুর রস আধা গ্লাস পানির সাথে মিশ্রণ বানিয়ে একটি পানীয় তৈরি করে নিয়মিত পান করুন। এইভাবে নিয়মিত পান করলে এক সপ্তাহের মধ্যে এর ফলাফল উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য করতে পারবেন।
এছাড়া এক টেবিল চামচ তাজা লেবুর রস সকালে খালি পেটে পান করলে এর উল্লেখযোগ্যভাবে ফলাফল বোঝা যাবে। তাজা লেবুর রসের রয়েছে পেকটিন নামক একটি উপাদান যা ব্যথা দূর করতে এবং পিত্তথলির পাথর অপসারণ করতে সহায়তা করে থাকে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে পেপারমিন্টঃ
এক চা চামচ গোল মরিচের পাতা এক কাপ পানিতে পাঁচ মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করতে হবে, তারপর এক চা চামচ মধু তার সঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এই ভাবেই তৈরি হয় পেপারমেন্ট চা।
এই পিপারমেন্ট চা ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ নিয়মিত ব্যবহার করলে পিত্তথলির ব্যথা জনিত সমস্যার উল্লেখযোগ্য সমাধান লক্ষ্য করা যাবে। পেপারমেন্ট এ টেরপিন নামক একটি যৌগ উপস্থিতি থাকে, যা পিত্তথলিতে তীব্র ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে সবজির জুসঃ
বিটের মূল একটি, শসা একটি এবং মাঝারি আকারের গাজর চারটি, এই তিনটি মিশ্রণ দিয়ে জুস বানাতে হবে ইহাই সবজি জুস। এই সবজির জূস দিনে দুইবার করে, দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত নিয়মিত পান করলে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
শসা তে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি থাকে, এই পানি লিভারের ডিটক্সিফাইং এর জন্য দারুন কাজ করে থাকে। গাজরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, এটি রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে করে।
বীটের মূল লিভার পরিষ্কার করতে, এবং পিত্তথলিকে অধিক শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। সুতরাং বলা যায় যে,সবজির জুস পিত্তথলির পাথর অপসারণের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে কাঁচা হলুদঃ
কাঁচা হলুদ পেটের পীড়া সারানোর যম। হলুদের রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর গুণ। যা পিত্তরস কে সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মধু সঙ্গে কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খেলে শরীর বেশ ভালো থাকে এইভাবে প্রতিদিন তিন সপ্তাহ সেবন করলে গলব্লাডারের পাথর অপসরণের সহায়তা করবে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে নারিকেল তেলঃ
পিত্তথলিতে পাথর অপসারণ করার আরেকটি ঘরোয়া উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে নারিকেল তেল। এক কোয়াটার গ্লাস আপেলের জুসের সঙ্গে তিন চা চামচ নারিকেল তেল, রসুন ৫ কোয়া এবং এক টুকরো আদা মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এই মিশ্রণ নিয়মিত প্রতিদিন খালি পেটে সেবন করলে চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করার ক্ষেত্রে দারুন কাজ করে।
পিত্তথলির পাথর অপসরণে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ
অনেকের মতে, অপারেশন করে পিত্তথলির পাথর সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে, পিত্তথলি কেটে দেওয়া হয়। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আবার ল্যাপরোস্কপির মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর বের করলে কিছু পাথর থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং,
সেখানে আবার পাথর তৈরি হওয়ারও সুযোগ রয়েছে।পিত্তথলির পাথর অপসারণের জন্য প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায় ছাড়া এলোপ্যাথিক ওষুধ দিয়ে তেমন কোন চিকিৎসা করা করার মত সুযোগ নেই। সুতরাং পিত্তথলির পাথর অপসারণ করার জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় উত্তম বলে অনেকে মনে করেন।
পিত্তথলির পাথর রোগীদের জন্য সতর্কতা
পিত্তথলির পাথর সরানোর বা দূর করানোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করার পরেও এ সমস্ত রোগীদের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মত অনুসারে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি,পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণ। এ সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে খাদ্য অভ্যাসের দিকে বিশেষ নজর রাখা উচিত যেমনঃ
- ভাজা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
- ফ্যাট যুক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করতে হবে কারণ চর্বিযুক্ত খাবার হজম করতে পিত্তথলিকে অনেক কষ্ট করতে হয়।
- লাল মাংস,মুরগির মাংস,ডিম খাওয়া বাদ দিতে হবে।
- চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার বন্ধ করা উচিত।
- বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চা,কফি তামাক বর্জন করতে হবে।
- দৈনিক চার থেকে পাঁচ লিটার পানি অতিরিক্ত পান করতে হবে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম যেন হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
- দুইটি খাবারের মাঝে অতিরিক্ত বিরতি হলে এ সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।
- একনগরের দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া কমাতে হবে।
মন্তব্য
পরিশেষে বলা যায় যে, পিত্তথলির পাথর অপসারণের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি গুলোই সর্বোত্তম । তবে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, পাথরের পরিমাণ ছোট হলে তা চিকিৎসা করে সহজেই অপসারণ করা যায় তা না হলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ও থাকে। তাই পেটে পিত্তথলিতে পাথর হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
আমার এই প্রতিবেদনটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে একটি শেয়ার করবেন, এর ফলে অনেকেই উপকৃত হবে, এবং এ সম্পর্কিত তথ্য জানার সুযোগ পেয়ে যাবে। এতক্ষণ ধরে আমার এ প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url